শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দোয়া শেষে মুখে হাত মোছা: সুন্নত নাকি সংস্কৃতি?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

দোয়া শেষে মুখে হাত মোছা: সুন্নত নাকি সংস্কৃতি?

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে দোয়া বা মোনাজাত শেষে মুখে হাত মোছা একটি বহুল প্রচলিত বিষয়। অনেকে এটিকে সুন্নত মনে করে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন, আবার অনেকে এটিকে স্থানীয় সংস্কৃতি বলে উড়িয়ে দেন। আসলে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে এই আমলের অবস্থান কী? হাদিসের দলিল এবং ইসলামিক স্কলারদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

প্রাসঙ্গিক হাদিস

১. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন- كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ فِي الدُّعَاءِ لَمْ يَرُدَّهُمَا حَتَّى يَمْسَحَ بِهِمَا وَجْهَهُ ‘রাসুলুল্লাহ (স.) যখন দোয়ার জন্য হাত উঠাতেন, তখন মুখমণ্ডল মুছে না নেওয়া পর্যন্ত হাত নামাতেন না।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৩৮৬)

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনা- إِذَا دَعَوْتُمْ اللَّهَ فَادْعُوا بِبُطُونِ أَكُفِّكُمْ، وَلَا تَدْعُوا بِظُهُورِهَا، فَإِذَا فَرَغْتُمْ فَامْسَحُوا بِهَا وُجُوهَكُمْ ‘তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করলে হাতের তালু দিয়ে করবে, হাতের পিঠ দিয়ে নয়। দোয়া শেষে সেই হাত দিয়ে মুখমণ্ডল মুছে নেবে।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ১১৮১)

আরও পড়ুন: দোয়া কালেমার মাধ্যমে শেষ করা যায়?

হাদিসের মান ও ইসলামিক স্কলারদের বিশ্লেষণ

হাদিসের সনদগত অবস্থা: উল্লিখিত হাদিসগুলোর সনদ দুর্বল (যঈফ) পর্যায়ের। হাদিস বিশারদ ইমাম তিরমিজি নিজেই প্রথম হাদিসটিকে ‘গরিব’ বলেছেন, যা নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে সর্বোচ্চ স্তরের নয়।

ফুকাহায়ে কেরামের মতামত

১. ইমাম নববি (রহ.) বলেন- ‘এই আমলের জন্য হাদিস দুর্বল হলেও ফাজায়েল বা শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস অনুসরণ জায়েজ। (আল-মাজমু)
২. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘দোয়ার পর হাত মুখে মুছার অভ্যাস আছে, তবে এটি ওয়াজিব বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়।’ (মাজমু আল-ফাতাওয়া)
৩. ইমাম শাওকানি (রহ.) বলেন, ‘এটি মুসতাহাব বা পছন্দনীয় আমল, তবে বাধ্যতামূলক নয়।’ (নাইলুল আওতার)

প্রকৃত শরয়ী হুকুম: জায়েজ কিন্তু ওয়াজিব নয়। অর্থাৎ মুখে হাত মোছা দলিলবিহীন নয়; দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে আমল করা যায়, সেট ভালো। না মুছলেও কোনো গুনাহ বা ইবাদত বিনষ্ট হবে না।

আরও পড়ুন: যেভাবে দোয়া করলে আল্লাহ খুশি হন

দোয়ার প্রকৃত শিষ্টাচার: যা প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ

দোয়ায় হাত মোছা না মোছার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দোয়ার আদব রক্ষা করা। রাসুল (স.) বলেছেন- ‘দোয়া করো এ বিশ্বাস নিয়ে যে আল্লাহ তা কবুল করবেন। আর জেনে রাখো, আল্লাহ উদাসীন ও অমনোযোগী হৃদয়ের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি: ৩৪৭৯)

দোয়ার মূল আদবসমূহ

১. বিনয় ও একাগ্রতা সহকারে দোয়া করা।
২. হালাল উপার্জন থেকে খাওয়া।
৩. যথাসম্ভব বিনয় প্রকাশ করা।
৪. দোয়ার শুরুতে আল্লাহর হামদ ও রাসুলের উপর দরুদ পড়া।
৫. দোয়ার মধ্যে তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপট: সংস্কৃতি বনাম শরিয়ত

উপমহাদেশে এই অভ্যাস এতটাই প্রচলিত যে অনেকেই ভাবে এটি ছাড়া দোয়া কবুল হয় না। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। ইসলামে দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত হলো ইখলাস, হালাল রুজি এবং বিনয়; কোনো বিশেষ শারীরিক অঙ্গভঙ্গি নয়।

সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে উঠে সুন্নতের অনুসরণ

ইসলামের সৌন্দর্য হলো এর ভারসাম্য। দোয়া শেষে মুখে হাত মোছা যদি কারো অভ্যাস হয় এবং তিনি দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে আমল করতে চান, তবে তা জায়েজ। কিন্তু এটি কখনোই দোয়ার আসল রুহ বা মূল উপাদান নয়। আসল বিষয় হলো দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা, অন্তর নম্র করা এবং আত্মসমর্পণের মনোভাব তৈরি করা।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর