শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মসজিদে কথাবার্তা: শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি ও জাল বর্ণনা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

মসজিদে কথাবার্তা: শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি ও জাল বর্ণনা

মসজিদ পৃথিবীর সর্বাধিক পবিত্র ও সম্মানিত স্থান। এটি মূলত নামাজ, ইবাদত, জিকির-আজকার এবং ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার জন্য নির্ধারিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘এসব মসজিদ বানানো হয়েছে আল্লাহর স্মরণ ও আলোচনা, নামাজ ও কোরআন পাঠের জন্য।’ (সহিহ মুসলিম: ২৮৫)

কথাবার্তার বৈধতা

শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় দুনিয়াবি বৈধ কথাবার্তা মসজিদে বলা জায়েজ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে। সহিহ হাদিসে এসেছে- ‘সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববীতে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা করতেন।’ (সহিহ বুখারি: ১/৬৩-৬৫; সহিহ মুসলিম: ২৮৫) ফিকহের গ্রন্থাদিতেও এর অনুমতির কথা উল্লেখ রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার: ১/৬৬২)

ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত

হজরত ওমর (রা.) একবার মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলার কারণে দুই ব্যক্তিকে সতর্ক করে বলেন- ‘তোমরা যদি মদিনার বাসিন্দা হতে, তাহলে মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলার কারণে আমি কঠোর শাস্তি দিতাম।’ (সহিহ বুখারি: ৪৭০) আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) মসজিদে জোরে কথা বলার কারণে এক ব্যক্তিকে ধমক দেন। (সহিহ বুখারি: ৪৭১)

আরও পড়ুন: মসজিদের আদব: আল্লাহর ঘরে নিষিদ্ধ ১১ কাজ


বিজ্ঞাপন


জাল বর্ণনা সম্পর্কে সতর্কতা

মসজিদে কথা বলা নিয়ে সমাজে কিছু জাল বর্ণনা প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ‘মসজিদে কেউ কথা বললে ফেরেশতারা বলে- হে আল্লাহর ওলি! চুপ করো… হে আল্লাহর দুশমন! চুপ করো… তোমার ওপর আল্লাহর লানত।’ এরকম আরেকটি বর্ণনা হলো- ‘মসজিদে কথাবার্তা নেকিকে ধ্বংস করে, যেমন আগুন কাঠকে ভস্ম করে।’ আরেকটি ভিত্তিহীন কথা বলা হয়ে থাকে যে- ‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খেয়ে ফেলে, যেমন পশু ঘাস খায়।’

এসব বর্ণনা কোনো হাদিস নয়, এর কোনো সনদও নেই। হাদিস বিশারদ শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আশশাকিরি (রহ.) তাঁর আস-সুনানু ওয়াল মুবতাদিআত গ্রন্থে এগুলোকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। (পৃ. ৫৩)

বৈধ কথাবার্তার উদাহরণ

সাহাবায়ে কেরাম ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে বসে থাকতেন। এ সময় তারা স্বাভাবিক আওয়াজে কথাবার্তা বলতেন এবং জাহেলি যুগের গল্প করে হাসতেন। নবীজি (স.)-ও তাদের গল্প শুনে মুচকি হাসতেন। (সহিহ মুসলিম: ৬৭০)

আরও পড়ুন: মসজিদে যেসব কাজ বৈধ

মসজিদের আদব ও নিষিদ্ধ কাজ

মসজিদের মর্যাদা রক্ষা করা ঈমানের দাবি। এ কারণে মসজিদকে ক্রয়-বিক্রয়, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বা ঝগড়া-বিবাদের আসরে পরিণত করা নিষিদ্ধ। নবীজি (স.) বলেন- ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রূপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চৈঃস্বর, দণ্ড প্রদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো।’ (ইবনে মাজাহ: ৭৫০)

অন্য হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা মসজিদে বাজারের ন্যায় কোলাহল ও দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে দূরে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৩২; আবু দাউদ: ৬৭৫)

এছাড়া অন্য মুসল্লিদের ইবাদতে যেন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) মসজিদে ইতেকাফকালে সাহাবিদের উচ্চস্বরে কেরাত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন- জেনে রাখো! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে চুপিসারে আলাপে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে কেরাত বা সালাতে আওয়াজ উঁচু করো না’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৩৩২) আরেক হাদিসে তিনি বলেন- ‘কোনো ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮)

অতএব, শরিয়ত সম্মত ও প্রয়োজনীয় কথাবার্তা মসজিদে বলা জায়েজ। তবে এ স্থানকে অযথা আলাপ, উচ্চস্বরে কথাবার্তা বা কোলাহলের কেন্দ্র বানানো নিষিদ্ধ। মসজিদের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি মুসল্লির দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মসজিদের আদব মেনে চলার এবং এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাওফিক দিন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর