মসজিদ পৃথিবীর সর্বাধিক পবিত্র ও সম্মানিত স্থান। এটি মূলত নামাজ, ইবাদত, জিকির-আজকার এবং ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার জন্য নির্ধারিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘এসব মসজিদ বানানো হয়েছে আল্লাহর স্মরণ ও আলোচনা, নামাজ ও কোরআন পাঠের জন্য।’ (সহিহ মুসলিম: ২৮৫)
কথাবার্তার বৈধতা
শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় দুনিয়াবি বৈধ কথাবার্তা মসজিদে বলা জায়েজ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে। সহিহ হাদিসে এসেছে- ‘সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববীতে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা করতেন।’ (সহিহ বুখারি: ১/৬৩-৬৫; সহিহ মুসলিম: ২৮৫) ফিকহের গ্রন্থাদিতেও এর অনুমতির কথা উল্লেখ রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার: ১/৬৬২)
ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
হজরত ওমর (রা.) একবার মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলার কারণে দুই ব্যক্তিকে সতর্ক করে বলেন- ‘তোমরা যদি মদিনার বাসিন্দা হতে, তাহলে মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলার কারণে আমি কঠোর শাস্তি দিতাম।’ (সহিহ বুখারি: ৪৭০) আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) মসজিদে জোরে কথা বলার কারণে এক ব্যক্তিকে ধমক দেন। (সহিহ বুখারি: ৪৭১)
বিজ্ঞাপন
জাল বর্ণনা সম্পর্কে সতর্কতা
মসজিদে কথা বলা নিয়ে সমাজে কিছু জাল বর্ণনা প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ‘মসজিদে কেউ কথা বললে ফেরেশতারা বলে- হে আল্লাহর ওলি! চুপ করো… হে আল্লাহর দুশমন! চুপ করো… তোমার ওপর আল্লাহর লানত।’ এরকম আরেকটি বর্ণনা হলো- ‘মসজিদে কথাবার্তা নেকিকে ধ্বংস করে, যেমন আগুন কাঠকে ভস্ম করে।’ আরেকটি ভিত্তিহীন কথা বলা হয়ে থাকে যে- ‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খেয়ে ফেলে, যেমন পশু ঘাস খায়।’
এসব বর্ণনা কোনো হাদিস নয়, এর কোনো সনদও নেই। হাদিস বিশারদ শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আশশাকিরি (রহ.) তাঁর আস-সুনানু ওয়াল মুবতাদিআত গ্রন্থে এগুলোকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। (পৃ. ৫৩)
বৈধ কথাবার্তার উদাহরণ
সাহাবায়ে কেরাম ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে বসে থাকতেন। এ সময় তারা স্বাভাবিক আওয়াজে কথাবার্তা বলতেন এবং জাহেলি যুগের গল্প করে হাসতেন। নবীজি (স.)-ও তাদের গল্প শুনে মুচকি হাসতেন। (সহিহ মুসলিম: ৬৭০)
মসজিদের আদব ও নিষিদ্ধ কাজ
মসজিদের মর্যাদা রক্ষা করা ঈমানের দাবি। এ কারণে মসজিদকে ক্রয়-বিক্রয়, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বা ঝগড়া-বিবাদের আসরে পরিণত করা নিষিদ্ধ। নবীজি (স.) বলেন- ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রূপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চৈঃস্বর, দণ্ড প্রদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো।’ (ইবনে মাজাহ: ৭৫০)
অন্য হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা মসজিদে বাজারের ন্যায় কোলাহল ও দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে দূরে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৩২; আবু দাউদ: ৬৭৫)
এছাড়া অন্য মুসল্লিদের ইবাদতে যেন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) মসজিদে ইতেকাফকালে সাহাবিদের উচ্চস্বরে কেরাত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন- জেনে রাখো! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে চুপিসারে আলাপে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে কেরাত বা সালাতে আওয়াজ উঁচু করো না’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৩৩২) আরেক হাদিসে তিনি বলেন- ‘কোনো ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮)
অতএব, শরিয়ত সম্মত ও প্রয়োজনীয় কথাবার্তা মসজিদে বলা জায়েজ। তবে এ স্থানকে অযথা আলাপ, উচ্চস্বরে কথাবার্তা বা কোলাহলের কেন্দ্র বানানো নিষিদ্ধ। মসজিদের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি মুসল্লির দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মসজিদের আদব মেনে চলার এবং এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাওফিক দিন। আমিন।

