রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নবীজি (স.) যেভাবে কথা বলতেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৪:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

নবীজি (স.) যেভাবে কথা বলতেন

প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন। তাঁর কথাবার্তা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন—প্রত্যেকটি বিষয়ই ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন শুদ্ধভাষী, সুমার্জিত ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গির অধিকারী। তাঁর কথায় কোনো বাহুল্য, অতিশয়োক্তি বা সীমালঙ্ঘন ছিল না। তাঁর কথাগুলো ছিল পরিশুদ্ধ, পরিমিত, শালীন এবং সুরুচিসম্পন্ন। তিনি কখনো রুক্ষ বা কর্কশ মেজাজের ছিলেন না, মন্দ কথা বলতেন না, এমনকি রাজা-বাদশাহদের মতো গম্ভীর হয়ে বসেও থাকতেন না। নবীজির (স.) কথাবার্তার ১০টি অনন্য সৌন্দর্য নিচে তুলে ধরা হলো।

১. সত্যবাদিতা

রাসুল (স.) সবসময় সত্য কথা বলতেন। শৈশব থেকেই তিনি ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) ও ‘আস-সাদিক’ (সত্যবাদী) নামে সুপরিচিত ছিলেন। এমনকি তাঁর ঘোর বিরোধী আবু সুফিয়ানও রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। রাসুল (স.) বলেন, ‘তুমি লিখে রাখ, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! এ মুখ থেকে সর্বাবস্থায় সত্য ছাড়া আর কিছু বের হয় না।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪৬)। তাঁর জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ ছিল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

২. মিষ্টতা

নবীজি (স.)-এর কথাবার্তা ও আচরণে ছিল সীমাহীন কোমলতা। তিনি কখনো কর্কশ বা রূঢ় ভাষায় কথা বলতেন না। কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর এই গুণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে মানুষ আপনার থেকে দূরে চলে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)। তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কাউকে কটু কথা বলে কষ্ট দিতেন না।

আরও পড়ুন: প্রিয়নবীর পছন্দের ১৫ খাবার


বিজ্ঞাপন


৩. বিশুদ্ধতা

রাসুল (স.) ছিলেন আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী। তাঁর উচ্চারণ, শব্দ প্রয়োগ ও বাচনভঙ্গি সবই ছিল বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমি কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছি এবং বনু সাদ গোত্রে প্রতিপালিত হয়েছি, এজন্যই আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী।’ (মুজামুল কাবির, তাবরানি, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা-৩৫)। তাঁর কথা ছিল আরবি ভাষার সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বের অনন্য উদাহরণ।

৪. স্পষ্টতা

নবীজি (স.)-এর কথা ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, প্রতিটি শব্দ শ্রোতার কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা দিত। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (স.)-এর কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে প্রত্যেক শ্রোতা তাঁর কথা বুঝত।’ (আবু দাউদ: ৪৮৩৯)। তিনি দ্রুত বা জড়িয়ে কথা বলতেন না।

৫. ধীরস্থিরতা

কথাবার্তায় ধীরস্থিরতা ছিল নবীজির অন্যতম গুণ। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন, যেন শ্রোতা প্রতিটি কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (স.) এমনভাবে কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারী তাঁর কথা গণনা করতে ইচ্ছা করে তবে সে গুনতে পারবে।’ (মুসলিম: ৭৩৯৯)। এই ধীরস্থিরতা তাঁর কথার গুরুত্ব ও গভীরতা বাড়িয়ে দিত।

আরও পড়ুন: নবীজির ৫টি মহামূল্যবান কথা জানেন না অনেকে

৬. শালীনতা

নবীজি (স.)-এর কথাবার্তা ছিল শালীনতায় পরিপূর্ণ। তিনি কখনো অশালীন, অভিশাপকারী বা গালিদাতা ছিলেন না। এমনকি কাউকে তিরস্কার করার প্রয়োজন হলেও তিনি শালীন ভাষা ব্যবহার করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (স.) অশালীন, অভিশাপকারী ও গালিদাতা ছিলেন না। তিনি কাউকে তিরস্কার করার সময় শুধু এটুকু বলতেন—কী হলো তার? তার কপাল ধূলিমলিন হোক।’ (বুখারি: ৬০৬৪)।

৭. হৃদয়গ্রাহিতা

রাসুল (স.)-এর কথাগুলো ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলত। তিনি এমনভাবে উপদেশ দিতেন, যেন কেউ বিরক্ত না হয়। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘নবীজি (স.) মাঝেমধ্যে আমাদের উপদেশ দিতেন, যেন আমরা বিরক্ত না হই।’ (বুখারি: ৬৮)। তিনি শ্রোতার মানসিক অবস্থা ও আগ্রহের প্রতি খেয়াল রেখে কথা বলতেন।

৮. বাহুল্যমুক্ত

নবীজি (স.) কখনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, অপ্রয়োজনীয় কথা ত্যাগ করা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলাম পালনের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অনর্থক কথা ও কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮)। তাঁর কথা ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অর্থপূর্ণ।

আরও পড়ুন: ভবিষ্যতের ৬ ফেতনা নিয়ে নবীজির দুশ্চিন্তা

৯. মর্মসমৃদ্ধ

রাসুল (স.)-কে ‘জাওয়ামি উল কালিম’ বা ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য বলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তিনি এমন সংক্ষিপ্ত কথা বলতেন, যা শব্দে অল্প হলেও ব্যাপক অর্থ বহন করত। তিনি বলেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ (মুসলিম: ৫২৩)। তাঁর এক একটি কথায় ইসলামের অনেকগুলো মূলনীতি লুকিয়ে থাকত।

১০. সময়োপযোগী

নবীজি (স.) পরিস্থিতি ও শ্রোতার স্তর বুঝে কথা বলতেন। প্রয়োজনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তা ভালোভাবে বোঝা যায়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (স.) তাঁর কথাকে তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তা ভালোভাবে বোঝা যায়।’ (শামায়েলে তিরমিজি: ২২২)। পরিবেশের কারণে তিনি গলার স্বর উঁচু-নিচু করতেন, যা তাঁর কথার প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দিত।

মোটকথা, নবীজি (স.)-এর বাচনভঙ্গি ছিল মানবজাতির জন্য এক পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ওহীর আলোয় আলোকিত, যা শুধু ভাষা ও শব্দের ব্যবহার শেখায় না, বরং জীবন পরিচালনার সঠিক দিকনির্দেশনাও দেয়। তাঁর এই অনন্য গুণগুলো অনুসরণ করে আমরাও নিজেদের কথাবার্তাকে আরও সুন্দর, অর্থবহ এবং কল্যাণকর করে তুলতে পারি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নবীজির জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় যত বেশি সম্ভব অনুসরণ-অনুকরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর