ইসলামি বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। এই মাসের ১২ তারিখ ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিনে মানবজাতির হেদায়াতের পথপ্রদর্শক, বিশ্বজাহানের রহমত, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) দুনিয়ায় আগমন করেন এবং একই দিনে ইন্তেকালও করেন। যদিও তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে, তবে অধিকাংশ ইসলামি ইতিহাসবিদ ও হাদিসবিদের মতে ১২ রবিউল আউয়াল তাঁর ওফাতের দিন হিসেবে অধিক নির্ভরযোগ্য। তাই এই দিনটি আমাদের জন্য যেমন স্মরণ ও কৃতজ্ঞতার, তেমনি আত্মসমালোচনা ও সুন্নাহতে ফিরে আসার দিন হওয়া উচিত।
করণীয়: সুন্নাহভিত্তিক আমল
১. দোয়া ও ইস্তেগফার: নবীজি (স.)-এর জন্য আল্লাহর কাছে রহমত ও মাগফিরাত প্রার্থনা করা। তাঁর উম্মাহর জন্য তাঁর ত্যাগ-তিতীক্ষা স্মরণ করে দোয়া করা এবং ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
২. সিরাতুন্নবী (স.) অধ্যয়ন ও প্রচার: সহিহ হাদিস ও প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে নবীজি (স.)-এর জীবন, আদর্শ, সংগ্রাম ও দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা। পরিবার-পরিজন, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কাছে তাঁর জীবনীর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপস্থাপন করা।
৩. সুন্নাহর অনুসরণ ও পুনর্জীবন: এই দিন হোক নবীজি (স.)-এর সুন্নাহকে জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞার দিন। সততা, আমানতদারিতা, প্রতিবেশীর হক আদায়, এতিম-গরিবদের সহায়তা, দ্বীনদারিত্ব ও সরলতা—এসব গুণে নিজেকে শোভিত করা।
বিজ্ঞাপন
৪. দরুদ ও সালাম: নবীজি (স.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা ঈমানের অংশ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। দরুদে ইবরাহিমি বা অন্যান্য প্রমাণিত দরুদ অধিক পরিমাণে পাঠ করা উচিত।
৫. দান-সদকা ও মানবসেবা: নবীজি (স.) দানশীলতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাঁর অনুসরণে গরিব-অসহায়দের সাহায্য, খাবার বিতরণ এবং কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত।
৬. জ্ঞানচর্চা ও দ্বীনি মাহফিলে অংশগ্রহণ: কোরআন-হাদিস ভিত্তিক বিশুদ্ধ আকিদার আলোচনায় অংশগ্রহণ করা। ভ্রান্ত মতবাদ, কুসংস্কার ও বিদআতের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
বর্জনীয়: বিদআত ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে বিরত থাকা
১. বিদআতপূর্ণ অনুষ্ঠান পরিহার: মিলাদ মাহফিল, জশনে জুলুস, আলোকসজ্জা, আতশবাজি বা উৎসবমুখর র্যালি—এসব ইসলামি শরিয়তে প্রমাণিত নয়। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনের যুগে এর কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
২. অতিরঞ্জিত আনন্দ-উল্লাস ও অপচয় এড়ানো: ১২ রবিউল আউয়াল জন্মদিনের আনন্দ উৎসবের দিন নয়, আবার এটি কেবল শোকের দিনও নয়। এদিনকে ঈদের মতো উদযাপন, বিশেষ পোশাক, ভোজসভার আয়োজন বা হইচইপূর্ণ কার্যক্রম ইসলামের শিক্ষা বহির্ভূত।
আরও পড়ুন: ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকে যেভাবে দেখেন মুসলিম মনীষীরা
৩. নবীজির মর্যাদা নিয়ে ভ্রান্তি: নবীজি (স.) মানুষ ছিলেন, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা ও রাসুল ছিলেন—এ বিশ্বাস রাখা আবশ্যক। তাঁকে আল্লাহর অংশ বা সৃষ্টির শুরু থেকে নূর মনে করা ভুল আকিদা ও গুনাহের কারণ হতে পারে।
৪. ছবি, মূর্তি বা শিরকি কাজ বর্জন: নবী-রাসুলদের ছবি আঁকা, প্রতিমূর্তি তৈরি বা কবর-মাজারকে কেন্দ্র করে বিশেষ আয়োজন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এটি তাওহিদের পরিপন্থী এবং শিরকের ঝুঁকি বহন করে।
৫. বিভেদ ও ঝগড়া সৃষ্টি না করা: ১২ রবিউল আউয়াল নিয়ে মতভেদ থাকলেও এ নিয়ে ঝগড়া, বিদ্বেষ বা ফিতনা সৃষ্টি করা অনুচিত। বরং ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সুন্নাহতে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানানো উচিত।
১২ রবিউল আউয়াল একটি মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনকে কেন্দ্র করে প্রকৃত করণীয় হলো—নবীজি (স.)-এর জীবন ও শিক্ষাকে জানা, তা জীবনে বাস্তবায়ন করা, সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা এবং বিদআত ও ভ্রান্ত কাজ থেকে বিরত থাকা। প্রকৃত ভালোবাসা আনুষ্ঠানিক উদযাপনে নয়, বরং তাঁর আদর্শ অনুসরণেই নিহিত। তাই এই দিন হোক নবীজি (স.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের অঙ্গীকার নবায়নের দিন।

