রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ধৈর্য ও ঈমানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হজরত বিলাল (রা.)

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০২:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ধৈর্য ও ঈমানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হজরত বিলাল (রা.)

ইসলামের ইতিহাসে কিছু নাম আছে যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তেমনই এক উজ্জ্বল নাম হজরত বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.)। তিনি শুধু ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিনই ছিলেন না, বরং চরম নির্যাতনের মুখেও ঈমানের ওপর অবিচল থাকার এক মহান প্রতীক। তাঁর ধৈর্য, সাহস, আত্মত্যাগ এবং দৃঢ়তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

দাসত্ব থেকে ঈমানের পথে

হজরত বিলাল (রা.) ছিলেন আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) অধিবাসী। মক্কার কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালাফের অধীনে তিনি দাস জীবন কাটাচ্ছিলেন। জন্মসূত্রে মক্কাবাসী হলেও সামাজিক মর্যাদায় ছিলেন অবহেলিত। কিন্তু যখন নবী (স.) সত্যের দাওয়াত দেন, তখন তিনি ছিলেন প্রথম সাতজন সাহাবীর অন্যতম, যারা প্রকাশ্যে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর বাহ্যিক রূপ কালো হলেও, অন্তর ছিল পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত, ধবধবে সাদা।

নির্যাতনের মুখে ‘আহাদ! আহাদ!’ ধ্বনি

ইসলাম গ্রহণের পর হজরত বিলাল (রা.)-এর ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। তাঁর মনিব উমাইয়া বিন খালফ তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করানোর জন্য নিত্যনতুন শাস্তির কৌশল বের করত।

মরুর উত্তপ্ত বালু ও পাথর: প্রতিদিন তাঁকে মক্কার উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে বুকে বিশাল পাথর চাপা দেওয়া হতো।


বিজ্ঞাপন


লোহার পোশাক: কখনো দুর্গন্ধময় গরুর চামড়ায় পেঁচিয়ে বা লোহার পোশাক পরিয়ে দুপুরের অগ্নিঝরা রোদে ফেলে রাখা হতো।

চাবুক ও টেনে হিঁচড়ে নেওয়া: চাবুকের আঘাতে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হতো, কখনোবা শিশুদের দিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে মক্কার অলিতে-গলিতে ঘুরানো হতো।

এত কষ্ট সহ্য করেও তাঁর মুখ থেকে শুধু একটিই শব্দ নিঃসৃত হতো—‘আহাদ! আহাদ!’ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)। কুরাইশরা তাঁকে বলত, ‘আমাদের দেব-দেবী লাত ও উয্যার নাম নাও, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব।’ উত্তরে বিলাল (রা.) বলতেন, ‘তোমাদের শব্দগুলো আমি উচ্চারণ করতে পারি না।’ (তথ্যসূত্র: সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, আসহাবে রাসুলের জীবন কথা, ইবনে হিশাম)

আরও পড়ুন: যে সাহাবির সঙ্গে কথা বলেছেন মহান আল্লাহ

আবু বকর (রা.)-এর মহানুভবতা ও বিলালের মুক্তির গল্প

হজরত বিলাল (রা.)-এর করুণ অবস্থা দেখে হজরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি বিপুল অর্থের বিনিময়ে উমাইয়া বিন খালফের কাছ থেকে তাঁকে কিনে নেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুক্ত করে দেন। এই ঘটনাটি ইসলামে দাসমুক্তির এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ও প্রিয়নবীর বিরহে আজান

মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (স.)-এর নির্দেশে হজরত বিলাল (রা.) ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত হন। তাঁর সুমধুর কণ্ঠের আজান শুনে মদিনার সবাই মসজিদে ছুটে আসত। রাসুল (স.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি এতটাই ব্যথিত হন যে, আর কখনো আজান দেবেন না বলে মনস্থির করেন।

পরবর্তীকালে, ১৬ হিজরিতে হজরত ওমর (রা.) যখন বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে যান, তখন তিনি হজরত বিলাল (রা.)-কে আজান দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর কণ্ঠে আজান শুনে হজরত ওমর (রা.)সহ উপস্থিত সকল সাহাবি ডুকরে কেঁদে ফেলেন।

আরও পড়ুন: দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যে সাহাবির

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি

একবার রাসুল (স.) হজরত বিলাল (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘বিলাল! কিসের বিনিময়ে তুমি আমার আগেই জান্নাতে চলে গেলে? গতরাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে তোমার পায়ের খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম।’

উত্তরে বিলাল (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যখনই কোনো গুনাহ করি, তখনই দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। আর যখনই অজু চলে যায়, তখনই অজু করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি।’ রাসুল (স.) বললেন, ‘এই দুই আমলের কারণেই তুমি এই মর্যাদা লাভ করেছ।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩২৪)

শেষ কথা, হজরত বিলাল (রা.)-এর জীবনী আমাদের শেখায়, দ্বীনের জন্য, ঈমান বাঁচানোর জন্য কতটুকু ত্যাগ করতে হয়। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, ইসলামে গায়ের রঙ বা সামাজিক অবস্থানের কোনো ভেদাভেদ নেই; বরং ঈমান, তাকওয়া এবং আমলের ভিত্তিতেই মানুষ মহান হতে পারে। তাঁর উচ্চারিত ‘আহাদ! আহাদ!’ ধ্বনি আজও প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয়, যারা সত্যকে ভালোবাসে এবং কষ্টের মাঝেও দ্বীনের ওপর অবিচল থাকতে চায়।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর