রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সন্তানের সুশিক্ষায় বাবার কর্তব্য

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ জুলাই ২০২৫, ০৮:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

সন্তানের সুশিক্ষায় বাবার কর্তব্য

পিতামাতার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সন্তানকে সুশিক্ষা ও সুন্দর নৈতিকতায় গড়ে তোলা। বিশেষ করে বাবা হিসেবে সন্তানের শিক্ষা ও বিকাশে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কোরআন-সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাস থেকে প্রমাণসহ সন্তানের সুশিক্ষায় বাবার কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখা

নবীজি (স.) বলেছেন, ‘সাত বছর বয়সে শিশুকে নামাজের নির্দেশ দাও, দশ বছর হলে শাসনের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করো’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৫)। এই হাদিসে ধাপে ধাপে শিক্ষাদানের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে, যা বাবা-মায়ের জন্য আদর্শ গাইডলাইন।

আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে (কোনো গুনাহ লেখা হয় না): ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগে, নাবালেগ শিশু যতক্ষণ না বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সুস্থ হয়’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৩৯৯)। এ হাদিস প্রমাণ করে শিশুর বয়স ও সক্ষমতা বিবেচনা করা জরুরি।

ইমাম আলী (রা.) বলতেন, ‘শিশুর মনকে প্রথমে প্রস্তুত করো (আদব কায়দা শেখাও), তারপর জ্ঞান দান করো’ (গুরারুল হিকাম ওয়া দুরারুল কালিম)। এ থেকে বোঝা যায়, শিশুর বয়স ও মানসিক প্রস্তুতি বিবেচনা করে শিক্ষা দেওয়া জরুরি।

২. বয়স ও সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষাদান

নবীজি (স.) শিশুদের সাথে এত নরমভাবে কথা বলতেন যে তা নির্দেশনার মতো মনে হত না (ফাতহুল বারি: ১০/৫৩৫)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শিশুদেরকে ধীরে ধীরে কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় দিতেন। এই পদ্ধতি শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী।

আরও পড়ুন: সন্তানের প্রতি মা-বাবার ১১ দায়িত্ব

৩. আবাসিক শিক্ষার সঠিক সময় নির্বাচন

নবীজি (স.) বলেছেন, ‘মায়ের কোলে শিশুর প্রথম শিক্ষা শুরু হয়।’ (শু'আবুল ঈমান, বায়হাকি: ৮৬১৯)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যে শিশুকে তার মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করা হয়, সে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না।’ (সুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ১৪৩৯৭)

সাহাবায়ে কেরাম শিশুদেরকে দশ বছর বয়সের আগে পরিবার থেকে দূরে পাঠাতেন না। ইবনে সিরিন (রা.) বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা নিতাম, পরে মসজিদে নববিতে গিয়ে জ্ঞানার্জন করতাম।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬০৬)

৪. ঘরের পরিবেশ দ্বীনদারি ও জ্ঞানময় করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম: ৬)। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘প্রতিটি শিশু ফিতরাত (ইসলামি স্বভাব) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এরপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, নাসারা বা অগ্নিপূজক বানায়।’ (সহিহ বুখারি: ১৩৮৫)

হজরত ওমর (রা.) তাঁর সন্তানদের নিয়ে প্রতিদিন কোরআন ও হাদিসের আলোচনা করতেন এবং তাদেরকে ন্যায়পরায়ণতা শেখাতেন। (আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৪৪) এটি পরিবারে দ্বীনি পরিবেশ বজায় রাখার একটি আদর্শ উদাহরণ।

আরও পড়ুন: সন্তান বিখ্যাত আলেম হওয়ার কোনো আমল আছে?

৫. সন্তানের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা

নবীজি (স.) শিশুদের উৎসাহ দিতেন। একবার এক শিশু পাখি শিকার করে আনলে নবীজি (স.) তাকে বললেন, ‘তুমি একজন দক্ষ শিকারী হতে পারবে!’ (আবু দাউদ: ৪৯৪৯) - এতে শিশুটির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

ইমাম শাফেয়ি (রা.) ছোটবেলায় দুর্বল শিক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু তাঁর উস্তাদ তাকে ধৈর্য্য শিখিয়েছিলেন। পরে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেম হয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে ধৈর্য্য ও সঠিক গাইডেন্সের মাধ্যমে শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা সম্ভব।

৬. ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার ব্যবস্থা করা

নবীজি (স.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ’ (ইবনে মাজাহ: ২২৪)। সাহাবি আবু দারদা (রা.) বলতেন, ‘কোরআন শেখার পাশাপাশি দুনিয়াবী প্রয়োজনীয় জ্ঞানও অর্জন করো।’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া: খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২১০)

আরও পড়ুন: সন্তানকে নামাজি বানালে যে প্রতিদান পাবেন

হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর কন্যা আয়েশা (রা.)-কে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বহুমুখী শিক্ষা দিয়েছিলেন। (আল-ইসতিআব ফি মারিফাতিল আসহাব: খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৮৮২) এটি ইসলামে ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ইসলামে সন্তান লালন-পালন কেবল পার্থিব দায়িত্ব নয়, বরং সর্বোত্তম আখিরাতের বিনিয়োগ। নবীজি (স.)-এর বাণী অনুযায়ী, সবচেয়ে উত্তম উত্তরাধিকার হলো সৎ সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করবে। (সহিহ মুসলিম: ১৬৩১)। তাই প্রতিটি বাবার কর্তব্য সন্তানকে এমন সুশিক্ষায় গড়ে তোলা, যাতে সে দ্বীনদার হিসেবেই শুধু নয়—আপনার জন্য সদকার সাওয়াবের ধারকও হয়।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর