বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামি শরিয়তে এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নানা কৌশলে এই প্রথা সমাজে টিকে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৮৭ শতাংশ বিয়েতে কোনো না কোনোভাবে যৌতুক লেনদেন ঘটে।
ইসলামের দৃষ্টিতে যৌতুক: স্পষ্ট হারাম
ইসলামি ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মাবসুত-এ বলা হয়েছে, ‘যৌতুক গ্রহণ করা রিবার (সুদ) মতোই হারাম।’ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি যৌতুক দাবি করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৬৫)
ভয়াবহ পরিসংখ্যান: নারী নির্যাতনের উৎস
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৪ সালের এক জরিপে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য যে, ৬৮ শতাংশ নারী যৌতুকের শিকার। প্রতি মাসে গড়ে ১১টি যৌতুকজনিত সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ২০২৩ সালে যৌতুকের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪২টি। এই পরিসংখ্যানগুলো প্রমাণ করে, যৌতুক শুধু অর্থনৈতিক নয়, জীবনবিনাশী একটি সমস্যা।
বিজ্ঞাপন
যৌতুকের আধুনিক রূপ: ছদ্মবেশে প্রথা চালু
- উপহারের নামে যৌতুক: বিয়ের আগে ‘উপহার’ হিসেবে গাড়ি, ফ্ল্যাট বা নগদ অর্থ দাবি করা হয়। দাবিতে অনেকসময় কথার ছলছাতুরি থাকে। আদায় না করলে অলিখিত হুমকি থাকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে বিয়েতে উপহারের ৯২ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে যৌতুক।
- শর্তের ফাঁদে ফেলা: ‘বিদেশে যেতে হবে’, ‘ব্যবসার জন্য মূলধন লাগবে’— এমন শর্তে টাকা আদায় এক ধরনের আধুনিক যৌতুক।
- মহরানার অপব্যবহার: ইসলামে মহর নির্ধারিত হলেও বাস্তবে অনেকেই এটিকে যৌতুক আদায়ের হাতিয়ার বানান। ফতোয়া বিভাগ জানায়, ৬৫-৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মহরানার নামে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়। মুফতি তাকি উসমানী এ বিষয়ে বলেন, ‘মহরের অজুহাতে অধিক সম্পদ দাবি করা হলে তা যৌতুকের রূপ ধারণ করে এবং তা হারাম।’ (ইসলাম আওর জদিদ মা’ইশাতি মাসাইল: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৪৫)
আইন আছে, প্রয়োগ দুর্বল
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুযায়ী, যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের ধারা অনুযায়ী: সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। ২০২৩ সালে এ আইনে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১,২৪৫টি। কিন্তু বাস্তবে এই আইন প্রয়োগে দুর্বলতা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে অনেকের।
আরও পড়ুন: হাদিসের আলোকে সর্বোত্তম বিয়ে
সমাধানের পথ: ধর্মীয় ও সামাজিক সমন্বয় জরুরি
ইসলামিক চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১. মসজিদভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে ২. ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিয়ের ঋণ সহজলভ্য করতে হবে ৩. সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা প্রচার বাড়াতে হবে। তিনি মনে করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে জনসচেতনতা গড়ে তুললে এই ব্যাধি কমে আসবে।
জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক বলেন, ‘আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, যৌতুকের দাবিতে কন্যেপক্ষকে নিঃস্ব করা হচ্ছে, নারীদের মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে—এসব ইসলামের দৃষ্টিতে জুলুম।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘কোনো পরিবার যদি স্বেচ্ছায় উপহার দেয়, সেটি আলাদা কথা। কিন্তু বিয়ের শর্ত হিসেবে টাকা-পয়সা বা সম্পত্তি দাবি করা সম্পূর্ণ হারাম। আমাদের মসজিদ-মক্তব থেকে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
ইসলামি মূল্যবোধই পারে সমাধান দিতে
যৌতুক শুধু একটি আর্থিক লেনদেন নয়, এটি ধ্বংস করে ইসলামি নীতিমালা, নারীর সম্মান ও সমাজের নৈতিকতা। তাই সমাজ, পরিবার এবং ব্যক্তি সকলকে একযোগে দাঁড়াতে হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ইসলামের স্পষ্ট অবস্থান এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগই পারে যৌতুক মুক্ত একটি সমাজ গড়তে।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
বাংলাদেশ পুলিশ সাইবার ক্রাইম ইউনিট
আল-মাবসুত

