সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় ইস্যুতে নানা গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের গুজব শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে না, বরং সমাজে উত্তেজনা, সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের ক্ষেত্র তৈরি করে। এ পরিস্থিতিতে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব—সত্যতা যাচাই করে তবেই প্রতিক্রিয়া জানানো।
নিচে ধর্মীয় গুজব যাচাইয়ের ৭টি সহজ ও কার্যকর উপায় দেওয়া হলো
১. উৎস যাচাই করুন
প্রথমেই দেখুন—খবরটি কোথা থেকে এসেছে। অচেনা ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলের খবর সহজে বিশ্বাস করবেন না। সরকারি বা নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম থেকে খবর হলে সেটি সাধারণত যাচাই করা হয়।
২. ছবি ও ভিডিও যাচাই করুন
পুরনো বা ভিন্ন প্রসঙ্গের ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে নতুন গুজব তৈরি করা হয় প্রায়ই। Google Reverse Image Search বা InVID টুল ব্যবহার করে জানুন ছবিটি আগে কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
৩. তারিখ ও সময় দেখুন
অনেক সময় পুরনো ভিডিওকে “আজকের ঘটনা” বলে ছড়ানো হয়। ভিডিওতে থাকা পরিবেশ, গাড়ির নম্বর প্লেট, ভাষা, কিংবা সংবাদপত্রের তারিখ দেখে এর সময়কাল বোঝার চেষ্টা করুন।
৪. ঘটনার সঙ্গে জড়িত পক্ষের বক্তব্য দেখুন
একপক্ষের দাবি শুনেই বিশ্বাস না করে অপর পক্ষের বক্তব্যও শুনুন। বেশিরভাগ সময় প্রশাসন, পুলিশ বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোনো না কোনো ব্যাখ্যা দেয়—সেটি অনুসন্ধান করুন।
৫. ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন
বাংলাদেশে Rumor Scanner Bangladesh FactWatch, BoomLive (বাংলা) www.bdfactcheck.com ও AltNews ওয়েবসাইট গুজব শনাক্ত করে। এই সাইটগুলোতে বিষয়টি আগে যাচাই হয়েছে কি না তা দেখে নিন।
আরও পড়ুন: মিথ্যা সংবাদ প্রচারের ভয়াবহ শাস্তি
৬. ভাইরাল অডিও বা ফরওয়ার্ড বার্তা সাবধানে মূল্যায়ন করুন
‘এটা গোপন খবর’, ‘শুধু মুসলমানদের জানানো হলো’— এ ধরনের বার্তা বা অডিও বেশিরভাগ সময় গুজব হয়। এসব ফরওয়ার্ড মেসেজ না বিশ্বাস করা এবং না ছড়ানোই উত্তম।
৭. নিজেই শেয়ার করার আগে ভাবুন
আপনার শেয়ার করা একটি মিথ্যা পোস্ট সমাজে সহিংসতা বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই ‘তথ্য যাচাই ছাড়া প্রতিক্রিয়া নয়’—এই নীতিতে চলা উচিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করে দেখো...’ (সুরা হুজরাত: ৬)
নবীজির সতর্কতা স্মরণ করুন
কোনো সংবাদ যাচাই-বাছাই না করে প্রচার করলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে একজন মিথ্যুক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সব শোনা কথা প্রচার, ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯২)
আরও পড়ুন: যেসব ফেতনা নিয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন নবীজি
গুজব সৃষ্টিকারীর পরিণতি
গুজবের কারণে যদি সমাজে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা গুনাহের প্রচলন হয়ে যায়, এর দায়ভারও যিনি গুজব ছড়িয়েছেন তার ওপর এসে বর্তাবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎপথের দিকে ডাকবে সে তার অনুসারীর সমান সওয়াব পাবে, অথচ অনুসরণকারীর সওয়াব কমানো হবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে ডাকবে সে তার অনুসারীর সমান পাপে জর্জরিত হবে, তার অনুসারীর পাপ মোটেও কমানো হবে না।’ (আবু দাউদ: ৪৬০৯)
পবিত্র কোরআনে গুজব ছড়ানোর পরিণতি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ বা পাপ অর্জন করে, অতঃপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর তা আরোপ করে, তাহলে সে তো মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য গুনাহের বোঝা বহন করল।’ (সুরা নিসা: ১১২)
অতএব, গুজব প্রতিরোধে সচেতনতা, সংযম ও সত্য যাচাইই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এখানে আবেগের স্থান নেই। সত্য যাচাইয়ের মাধ্যমেই হোক ধর্মীয় সহনশীলতা রক্ষার পদক্ষেপ।
সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ধর্মীয় গুজব অনেক সময় মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ছড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে তথ্যসচেতনতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা—দুই-ই জরুরি।’
সামাজিক শান্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে গুজবের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি। যাচাই ছাড়া কিছুই বিশ্বাস নয়—সচেতনতা ও সহনশীলতাই হোক মুসলমানের আসল পরিচয়।