পবিত্র ঈদুল আজহার অন্যতম মৌলিক ইবাদত হলো কোরবানি। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা যেমন ইবাদত, তেমনি সে পশু কেনা, প্রস্তুত করা ও আদবের সঙ্গে যত্ন নেওয়াও ইবাদতেরই অংশ। অনেকে কোরবানির পশু কেনাকে কেবল দুনিয়াবি একটি কাজ হিসেবে ভাবেন, অথচ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের শুরু। তাই ইসলাম আমাদের এ কাজটিও কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা ও দোয়ার মাধ্যমে করতে শিখিয়েছে।
কোরবানির পশু কেনার আগে নিয়ত ঠিক করুন
যেকোনো ইবাদতের মূল ভিত্তি নিয়ত। হাদিসে এসেছে- ‘নিশ্চয়ই সব কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি: ১; সহিহ মুসলিম: ১৯০৭) তাই পশু কেনার আগে মনে মনে নিয়ত করুন: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করতে যাচ্ছি, যেন তিনি আমার ইবাদত কবুল করেন।
কোরবানির পশু কেনার সময় পড়ার দোয়া
ইসলামি ফিকহবিদ ও আলেমদের মতে, কোরবানির পশু কেনার সময় এই দোয়াটি পড়া মোস্তাহাব (পছন্দনীয়)— اللَّهُمَّ هٰذِهِ مِنْكَ وَلَكَ، تَقَبَّلْهَا مِنِّي উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা হাজিহি মিনকা ওয়ালাকা, তাকাব্বালহা মিন্নি।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! এই পশুটি আপনার পক্ষ থেকে এবং আপনারই জন্য। আপনি এটা আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।’
এ দোয়াটি আল্লাহর রসুল (স.) পশু জবাইয়ের সময় পড়েছেন, তবে কেনার সময়েও তা পড়া যায়—ইখলাসের সাথে ইবাদতের ভাব নিয়ে। (তবে এ দোয়া না পড়লে গুনাহ হবে না, এটি মোস্তাহাব মাত্র।)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: কোরবানির দোয়া ও পশু জবাইয়ের নিয়ম
কোরবানির পশু কেনার ৭টি গুরুত্বপূর্ণ আদব
১. পশু নির্বাচনে তাকওয়া ও সতর্কতা: কোনো অঙ্গহানিপ্রাপ্ত, অপুষ্ট বা রোগাক্রান্ত পশু কোরবানির জন্য কিনবেন না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- চার ধরনের ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি করা জায়েজ নয়— ১. অন্ধ যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, ২. রুগ্ন- যার রোগ সুস্পষ্ট, ৩. খোঁড়া- যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট, ৪. বৃদ্ধ ও দুর্বল-যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। (আবু দাউদ: ২৮০২; তিরমিজি: ১৪৯৭)
২. নিয়ম অনুযায়ী বয়স দেখা: বয়সের ক্ষেত্রে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা অন্তত এক বছর । গরু, মহিষ অন্তত দুই বছর ও উট অন্তত ৫ বছর হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে ছয় মাসেরটি দেখতে এক বছরের মতো লাগে, তাহলে সেটি দিয়ে কোরবানি হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে। তবে, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না। (কাজিখান: ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫-২০৬)
৩. অন্যকে ঠকানো থেকে বিরত থাকা: কোনো বিক্রেতা যেন আপনাকে রোগাক্রান্ত পশু না দেয়, আর আপনিও দরকষাকষির নামে কারও ক্ষতি না করেন। নবীজি (স.) বলেছেন, প্রতারক ও ধোকাবাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি: ১৩১৫)
৪. সুন্দর ব্যবহার ও দয়াশীলতা: পশুকে না তাড়ানো, না পেটানো, ক্রয় করার সময় কোমল ব্যবহার করা—এগুলোও ইসলামি আদব। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের সঙ্গে সদাচারের আদেশ করেছেন। সুতরাং যখন তোমরা (কিসাস ইত্যাদির কারণে) হত্যা করবে তখন উত্তমরূপে হত্যা করো। আর যখন জবেহ করো তখন উত্তমরূপে জবেহ করো। আর তোমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হলো ছুরি ধার দিয়ে নেওয়া এবং জাবিহাকে (জবাইকৃত জন্তু) যথাসম্ভব আরাম দেওয়া। (মুসলিম: ১৯৫৫)
আরও পড়ুন: যৌথ পরিবারে কোরবানি, সচরাচর ভুল ও সঠিক নিয়ম
৫. ইবাদতের অনুভূতি বজায় রাখা: পশু কেনা যেন কেবল একটি কেনাবেচা বা লোকদেখানো ইভেন্টে পরিণত না হয়; বরং এটিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত হিসেবে দেখা জরুরি। ইসলামি শরিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যেকোনো ভালো কাজ একেকটি ইবাদতরূপে গণ্য হয়।
৬. পশু কেনার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া: জিনিস কেনার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলা সুন্নত। এতে শয়তানের হস্তক্ষেপ কমে যায়।
৭. ক্রয় করে কোরবানির পশুকে সযত্নে রাখা: জবাইয়ের আগে পশুকে খাওয়ানো, পানি দেওয়া, গোসল করানো ইত্যাদিও ইসলামের দৃষ্টিতে রহমত ও সওয়াবের কাজ।
কোরবানির পশু কেনা কেবল একটি কেনাকাটা নয়, বরং একটি মহান ইবাদতের শুরু। তাই এ কাজটিও সচেতনভাবে, দোয়া ও আদবসহকারে করা উচিত। আল্লাহ যেন আমাদের নিয়ত শুদ্ধ করে, হালাল উপার্জনে কোরবানির পশু কিনে কবুলযোগ্য ইবাদত করার তাওফিক দান করেন। আমিন।

