মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো কথা দিয়ে কথা রাখা। এটি শুধু সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নয়, বরং ইসলামের একটি মৌলিক নৈতিক আদর্শ। একজন মুসলমানের চরিত্রে বিশ্বস্ততা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। মহান আল্লাহ এবং রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদেরকে এই গুণ অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং এর বিপরীত আচরণকে নিন্দা করেছেন।
কোরআনে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন- وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩৪)
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, কেয়ামতের দিন প্রতিটি অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো।’ (সুরা মায়েদা: ১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা কেন এমন কথা বলো! যা কাজে পরিণত করো না, এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ যে তোমরা বলবে এমন কথা যা করবে না।’ (সুরা সফ: ২-৩)
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর শিক্ষা
রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ সবচেয়ে বিশ্বস্ত। এমনকি ইসলাম গ্রহণের আগেও মক্কার লোকেরা তাঁকে এই উপাধিতে সম্মানিত করত। নবীজি বলেন, المسلمون على شروطهم ‘মুসলমানরা তাদের চুক্তি ও শর্ত পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৯৪)
অন্যদিকে, ‘চারটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে থাকবে, সে হবে খাঁটি মুনাফিক- আমানত ভঙ্গ করা, মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, ও ঝগড়ার সময় সীমা অতিক্রম করা।’ এর একটি বৈশিষ্ট্যও কারো থাকলে, তার মধ্যে মুনাফিকির একটি বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে বলেই বিবেচিত হবে। (দ্র. সহিহ বুখারি: ৩৪; সহিহ মুসলিম: ৫৮)
আরও পড়ুন: মিথ্যা ছেড়ে দেওয়ার ইসলামিক উপায়
প্রতিশ্রুতি রক্ষা মানবতার ভিত্তি
প্রতিশ্রুতি রক্ষা শুধু ইসলামি আদর্শ নয়, বরং এটি মানবতার মৌলিক ভিত্তি। একজন ব্যক্তি যদি কথার ঠিক না রাখে, তাহলে তার প্রতি বিশ্বাস হারায় সমাজ। এর ফলে পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি হয়।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা মুমিনের মূল্যবান গুণ
অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম দামী গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।’ (সুরা রাদ: ২০)
সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ
‘সাহাবায়ে কেরাম ওয়াদা রক্ষাকে এমনভাবে দেখতেন যেন তা ঈমানের অঙ্গ।’ (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক: ২০৭৬২; আল-আদাবুল মুফরাদ (ইমাম বুখারি): ৫৯৪)
প্রতিশ্রুতি রক্ষার সামাজিক প্রভাব
যদি সমাজের প্রতিটি সদস্য প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, তবে সমাজে আস্থা, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, কথা ভঙ্গ করা মানুষ ও সমাজের মাঝে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব ও ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন: যে ৪ গুণ থাকলে হারানোর কিছু নেই
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শাস্তি
যেসব লোক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তাদের সম্পর্কে কোরআনে কঠিন সতর্কবাণী এসেছে। বলা হয়েছে, ‘যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, আল্লাহর কসম ভেঙে ফেলে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে লানত এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা রাদ: ২৫)
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীর ওপর রাগান্বিত থাকবেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য অথবা তার ভাইয়ের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করবে, আল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এমন অবস্থায় ঘটবে যে, আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। এ কথার সত্যতার জন্য আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেন, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে, তারা আখেরাতের নেয়ামতের কোনো অংশই পাবে না।’ (বুখারি: ৬৬৫৯)
শেষ কথা, প্রতিশ্রুতি পালন করা মুসলিম চরিত্রের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গুণ নয় বরং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে সমাজে আস্থা, নিরাপত্তা ও পারস্পরিক ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আমাদের উচিত, সবসময় কথা দিয়ে কথা রাখা এবং আমানত রক্ষা করে একজন আদর্শ মুসলমান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার তাওফিক দান করুন এবং মিথ্যা ও প্রতারণা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

