ইসলামে সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন জুমার দিন। কোরআন ও হাদিসে এই দিনকে সাপ্তাহিক ঈদ বলা হয়েছে। এই দিনে একজন মুমিনের সকাল শুরু হওয়া উচিত বিশেষ প্রস্তুতি ও ইবাদতের মাধ্যমে। কারণ এ দিনের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা, ফজিলত এবং দোয়া কবুলের আশ্বাস। নিচে জুমার সকালের করণীয় বিষয়ে দলিলসহ আলোচনা করা হলো।
১. শেষ রাতে তহাজ্জুদ ও ইস্তিগফার
ইসলামে জুমার দিনসহ প্রতিদিনের প্রভাতে তাওবা ও ইস্তিগফার করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন প্রভুর ভালোবাসায় যে বান্দারা নামাজে দাঁড়ায়, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে’ (সুরা সাজদা: ১৬)। ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
২. গোসল ও পরিচ্ছন্নতা
জুমার দিনের গোসল নিয়ে অনেক নির্দেশমূলক হাদিস রয়েছে। এক হাদিসে রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘জুমার দিনে প্রত্যেক সাবালক ব্যক্তির জন্য গোসল করা ওয়াজিব।’ (বুখারি: ৮৭৯; মিশকাত: ৫৩৮) অন্য হাদিসে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমায় যাবে, সে যেন গোসল করে।’ (বুখারি: ৮৮২; মুসলিম: ৮৪৫)
তবে, জুমার দিনের গোসল ফরজ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন শুধু অজু করে, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট। আর যে গোসল করে, সেটা অবশ্যই উত্তম।’ (তিরমিজি: ৪৯৭; মিশকাত: ৫৪০)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্র হলো, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করবেন। (বুখারি: ৮৮৩)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: জুমার দিন সুন্দর পোশাক পরার গুরুত্ব
৩. দরুদ শরিফের প্রচুর আমল
জুমার দিন দরুদ পড়লে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতারা নবীজির কাছে তা পৌঁছিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো, কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। (আবু দাউদ: ১০৪৭)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আমার ওপর জুমার দিন বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কারণ আমার উম্মতের দরুদ জুমার দিন আমার কাছে পৌঁছানো হয়। যে ব্যক্তি আমার ওপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পাঠাবে, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন সবচেয়ে আমার নিকটতম হবে।’ (তারগিব: ১৫৭)
৪. সুরা কাহাফ পাঠ
জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়ার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার (ঈমানের) নূর এই জুমা হতে আগামি জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। (মেশকাত: ২১৭৫)
আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। (সহিহ মুসলিম: ৮০৯; আবু দাউদ: ৪৩২৩) আরেক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের শেষ ১০ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪৪৬/৬)
আরও পড়ুন: কেয়ামতের দিন জুমা আদায়কারীর বিশেষ সম্মান
৫. মসজিদে আগেভাগে যাওয়া
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন জুমার দিন উপস্থিত হয়ে ফেরেশতারা মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে আগন্তুকদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি উট সদকা করে। তারপর যে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি গাভী সদকা করে। তারপর যে আগমন করে তার সওয়াব মুরগি সদকাকারীর মতো। তারপর আগমনকারী একটি ডিম সদকাকারীর মতো সওয়াব পায়। এরপর যখন ইমাম খুতবা দিতে বের হন, তখন ফেরেশতারা তাদের দফতর বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনতে থাকেন।’ (সহিহ বুখারি: ৮৮২)
৬. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা
খুতবা শোনা জুমার নামাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ফজিলত অনেক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—‘যে ব্যক্তি উত্তমভাবে অজু করে জুমার নামাজে এলো, নীরবে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, তাহলে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং আরও অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করলো, সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো। (মুসলিম: ১৮৭৩)
জুমার খুতবা শোনা শুধু সওয়াবের কাজ না, এটি ওয়াজিব। তাই খুতবার সময় কোনো কথা বলা যাবে না। এমনকি কাউকে চুপ থাকতে বলাও নিষেধ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন—‘জুমার দিন যখন তোমার পাশের মুসল্লিকে চুপ থাকো বলবে, অথচ ইমাম খুতবা দিচ্ছেন, তা হলে তুমি একটি অনর্থক কথা বললে।’ (বুখারি: ৯৩৪, মুসলিম: ৮৫১)
আরও পড়ুন: জুমার খুতবা কি দুই রাকাত নামাজের সমতুল্য?
৭. দোয়া কবুলের সময় সন্ধানের চেষ্টা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, জুমার দিন একটা সময় আছে তখন কোনো মুসলিম নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর নিকট যা চাইবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দেবেন। (আবু হুরায়রা রা. বলেন,) এরপর রাসুল (স.) হাত দিয়ে ইশারা করেছেন, ওই মুহূর্তটা অতি অল্প সময়। (সহিহ বুখারি: ৯৩৫; সহিহ মুসলিম: ৮৫২)
অধিকাংশ ইমাম ও সাহাবায়ে কেরাম (র.)-এর মতে, এটি আছরের পর থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত সময়। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, সময়টি হলো- খতিব খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠার পর থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত। আমাদের উচিত, এই দুই সময়ে দোয়া ও জিকিরের চেষ্টা করা। তাহলে জুমাবারের বিশেষ সময়ের ফজিলত লাভ হবে এবং দোয়া কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।
জুমার সকাল একজন মুসলমানের জন্য শুধুমাত্র একটি দিন নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, আমল বৃদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগ। সঠিক প্রস্তুতি ও নিয়মে পালন করলে, এই দিন আমাদের জীবনে অনেক বরকত ও কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে।

