পবিত্র রমজান বিদায় নিয়েছে। ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে শুরু হয়েছে শাওয়াল মাস। এই মাসে মুমিনের নেকীর পাল্লা ভারী করার অনেক আমল রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো শাওয়াল মাসের ছয় রোজা। এ রোজাগুলোর ব্যাপারে উৎসাহমূলক কথা এসেছে হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায়।
শাওয়ালের রোজা কয়টি?
ঈদুল ফিতরের দিন দিয়ে শুরু হয় শাওয়াল মাস। ঈদের দিনটি ছাড়া পুরো মাসেই নফল রোজা রাখা যায়। তবে হাদিস শরিফে শাওয়াল মাসে মোট ৬টি নফল রোজা রাখার বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই ছয় রোজা টানা রাখা যায়, আবার বিরতি দিয়েও রাখা যায়। অর্থাৎ শাওয়াল মাসের মধ্যে নিজের সুবিধামতো মোট ছয়টি রোজা রাখলে হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
শাওয়ালের ৬ রোজা কেন?
শাওয়ালের ৬ রোজা অনেক ফজিলতপূর্ণ সুন্নত। এই রোজা নবীজি রাখতেন, উম্মতকেও রাখার জন্য উৎসাহিত করতেন। এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম: ১১৬৪; আবু দাউদ: ২৪৩৩)
আরও পড়ুন: যেসব দিনে নফল রোজা রাখতেন নবীজি
শাওয়ালের রোজার উত্তম সময় ২০২৫
ছয়টি নফল রোজা রাখতে হবে শাওয়াল মাস শেষ হওয়ার আগেই। অর্থাৎ এ বছর (২০২৫) ২৯ শাওয়াল মোতাবেক ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ রোজাগুলো রাখার সুযোগ থাকছে। এই রোজাগুলো রাখার ব্যাপারে বিশেষ কোনো দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি হাদিস শরিফে। বিজ্ঞ ফিকহবিদ ও আলেমদের অভিমত হলো— ঈদের দিনটি বাদ দিয়ে শাওয়াল মাসের যেকোনো ছয়দিনে রোজা রাখলেই হবে। ধারাবাহিকভাবেও এই ছয়টি রোজা রাখা যাবে, আবার বিরতি দিয়ে দিয়ে ছয়টি রোজা পূরণ করতে পারলেও হাদিসে বর্ণিত সওয়াব পাওয়া যাবে।
তবে, সুন্দর একটি পদ্ধতি হলো- সাপ্তাহিক সুন্নত রোজা অর্থাৎ প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজার সাথে মিল রেখে সহজেই শাওয়ালের রোজাগুলো রাখা যায়। কেউ যদি শাওয়াল মাসের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখে, তাহলে তিন সপ্তাহেই সহজে তার ছয়টি রোজা পূর্ণ হয়ে যাবে।
বিজ্ঞাপন
একইভাবে আইয়ামে বিজের সঙ্গে মিল রেখেও রোজাগুলো রাখা যায়। আইয়ামে বিজ বলতে হিজরি বছরের প্রতি মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে বোঝানো হয়। প্রতি মাসে এ দিনগুলোতে রোজা রাখা সুন্নত। সুতরাং শাওয়াল মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ এবং এর আগে পরে আরও তিনটি রোজা রাখা যায়।
তবে শাওয়ালের রোজাগুলো যত তাড়াতাড়ি আদায় করা যায় ততই ভালো। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সুরা মুমিনুন: ২৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং এমন জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার প্রশস্ততা হবে আকাশসমূহ ও জমিনসম। তা মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৩)
আরও পড়ুন: সোম-বৃহস্পতিবার নফল রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত
শাওয়ালের ৬ রোজা কাজা রোজার আগে নাকি পরে?
যাদের ভাংতি রোজা আছে, অসুস্থতা কিংবা নারীদের হায়েজ-নেফাসের কারণে রমজানের রোজা অপূর্ণ থাকে, তাদের জন্য নিয়ম ও করণীয় হলো—‘শাওয়াল মাসে তাদের ভাংতি রোজাগুলো আগে পূর্ণ করে নেবে। তারপর তারা শাওয়ালের ৬ রোজা পালন করবে। কেননা ‘..যার ওপর কাজা রয়ে গেছে সে রোজা পুর্ণ করেছে বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ ওই রোজাগুলোর কাজা আদায় না করে।’ (আল মুগনি: ৪৪০) সুতরাং আগে রমজানের রোজা পূর্ণ করবে, তারপর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখবে—তবেই সারাবছর রোজা রাখার সওয়াব মিলবে।
অনেকের রমজানের কাজা পূরণ করতে সারামাস লেগে যেতে পারে (যেমন নেফাসগ্রস্ত নারী যদি পুরো রমজানে একটি রোজাও না রাখতে পারেন), তাদেরকে পুরো শাওয়াল মাসে কাজা রোজা রাখতে হবে। তারা জিলকদ মাসে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারবে এবং শাওয়ালের বিশেষ ফজিলতও পাবে। কেননা সে শরিয়তসম্মত ওজরের কারণে বাধ্য হয়ে এই বিলম্ব করেছে। (ফতোয়া সমগ্র ১৯/২০, ফতোয়া নং-৪০৮২ ও ৭৮৬৩)
তবে, আরেকদল আলেমের মতে, কাজা রোজার সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে আগে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখা উত্তম। কেননা শাওয়াল শেষ হয়ে গেলে অন্যমাসে এই ৬ রোজার ফজিলত নেই। কিন্তু কাজা রোজা বছরের যেকোনো সময় রাখলেই আদায় হয়ে যায়।
শাওয়ালের ৬ রোজার ফজিলত
শাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের ফরজ রোজাগুলো রাখল, অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারাবছর ধরেই রোজা রাখল। (সহিহ মুসলিম: ১১৬৪) অন্য হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে ছয়দিন রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরোবছর রোজা রাখার সমতুল্য। (আহমদ: ২৮০, দারেমি: ১৭৫৫)
হাদিসগুলোতে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়টি হলো—আলাদাভাবে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজায় কিংবা পুরো রমজানের রোজায় একবছর নফল রোজার সওয়াব দেওয়া হবে না, বরং পুরো রমজান মাস রোজা রাখার পরে শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখলে তবেই পূর্ণ একবছর নফল রোজা রাখার সওয়াব লাভ হবে।
আরও পড়ুন: আইয়ামে বিজের রোজার ফজিলত
বস্তুত হাদিসগুলো পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে মিলে যায়। আয়াতটি হলো, ‘কেউ কোনো নেক আমল করলে, তাকে তার দশ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে।’(সুরা আনআম: ১৬০) রমজানের এক মাসের দশগুণ হলো ১০ মাস আর শাওয়াল মাসের ছয়দিনের দশগুণ হলো ৬০ দিন অর্থাৎ দুইমাস। সুতরাং ৩৬টি রোজায় সারা বছর বা ৩৬০টি রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।
তবে, এরকম শর্ত থাকলেও শরিয়তসম্মত কারণে রমজানের পূর্ণমাস রোজা রাখেননি—এমন লোকদের শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখাতে মানা নেই। বরং সেক্ষেত্রে নফল রোজার সীমাহীন নেকি তিনি পাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা নবীজি (স.) বেশিবেশি নফল রোজা নিজে তো রাখতেনই, সাহাবিদেরকেও উৎসাহিত করতেন। নফল রোজার মধ্যে আছে সাপ্তাহিক দুই রোজা (সোমবার ও বৃহস্পতিবার), মাসিক তিন রোজা (আইয়ামে বীজ তথা চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা), মহররম ও আশুরার রোজা, শাবান মাসের রোজা, শাওয়ালের ছয় রোজা, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রোজা বিশেষ করে ৯ তারিখের রোজার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করতেন প্রিয়নবী (স.)।
নফল ইবাদতের সীমাহীন গুরুত্ব বর্ণনায় পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যখন তুমি (ফরজ) দায়িত্ব সম্পন্ন করবে তখন উঠে দাঁড়াবে এবং তুমি (নফলের মাধ্যমে) তোমার রবের প্রতি অনুরাগী হবে।’ (সুরা ইনশিরা: ৭-৮)
আরও পড়ুন: শাওয়ালের ৬ রোজা যেভাবে রাখবেন
শাওয়ালের রোজা কাজা করা যাবে কি?
ফরজ ও ওয়াজিব আমলের কাজা করতে হয়, সুন্নতের কাজা হয় না। তাই শাওয়াল মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে ৬ রোজার সময়ও শেষ হয়ে যায়। তাই শাওয়ালের ৬ রোজা কাজা করার নিয়ম নেই। তবে, রমজানের কাজা পূরণ করতে যাদের সারামাস লেগে যেতে পারে (যেমন নেফাসগ্রস্ত নারী যদি পুরো রমজানে একটি রোজাও না রাখতে পারেন), তাদেরকে যেহেতু পুরো শাওয়াল মাসে কাজা রোজা রাখতে হবে, তাই তারা জিলকদ মাসে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারবে এবং শাওয়ালের বিশেষ ফজিলতও পাবে। কেননা সে শরিয়তসম্মত ওজরের কারণে বাধ্য হয়ে এই বিলম্ব করেছে। (ফতোয়া সমগ্র ১৯/২০, ফতোয়া নং-৪০৮২ ও ৭৮৬৩)
শাওয়ালের রোজা কখন শুরু করতে হয়?
ঈদুল ফিতরের দিন দিয়ে শুরু হয় শাওয়াল মাস। ঈদের দিনটি ছাড়া পুরো মাসেই সুবিধামতো সময়ে ৬টি রোজা রাখা যাবে। তাই আপনি চাইলে ঈদুল ফিতরের পরের দিন থেকে শাওয়াল মাসের ৬ রোজা শুরু করতে পারেন। চাইলে
ছয়টি রোজা সম্পূর্ণ করতে সোমবার ও বৃহস্পতিবারকে নির্দিষ্ট করতে পারেন। অথবা আইয়ামে বিজের তিন রোজার আগে পরে আরও তিন রোজা মিলিয়ে মোট ৬টি রোজা রাখতে পারেন। শাওয়াল মাস শেষ হওয়ার আগে ৬ রোজা সম্পূর্ণ করতে পারলেই হবে।