ইফতারের সময়টি খুবই মূল্যবান। এই সময়ের যেকোনো নেক আমলের মর্যাদা বেশি। কারণ রোজাদার তখন ক্ষুধার্ত থাকেন, এরপরও আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য মাগরিব পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। রোজাদারের এই অবস্থার কারণেই তখন দোয়া কবুল হয়। জিকির-আজকারের সওয়াব বেশি হয়। ইস্তেগফার করলে আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। আল্লাহর দয়ায় অনেক জাহান্নামি প্রতিদিন ইফতারের সময় মুক্তি লাভ করেন।
হজরত জাবির (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দেন। আর প্রতি রাতেই তা সংঘটিত হয়ে থাকে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৬৪৩)
বিজ্ঞাপন
সাধারণত আছরের নামাজের পর থেকে ইফতারের আয়োজন ও অপেক্ষা শুরু হয়। এই সময়টি জিকিরবিমুখ থাকা, নাটক-সিনেমা দেখা বা গল্প গুজবে কাটানো মোটেও কাম্য নয়।। তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে চাইলেই দোয়া, ইস্তেগফার, জিকির করা যায়। এই সময়ে দোয়া কবুলের ওয়াদা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া রদ হয় না। ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, সাওম পালনকারী—যতক্ষণ না সে ইফতার করে এবং মজলুমের দোয়া। (তিরমিজি: ৩৫৯৮; ইবনে মাজাহ: ১৭৫২)
আছরের পর থেকে ইফতারের পর্যন্ত এই দোয়া পড়ুন
ইফতারের আগমুহূর্তে যেকোনো দোয়া করা যায়। হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো পাঠ করা উত্তম। ওই সময় এই ছোট্ট দোয়াটি পাঠ করা যায়— يَا وَاسِعَ الْمَغْفِرَةِ اغْفِرْ لِي উচ্চারণ: ‘ইয়া ওয়াসিআল মাগফিরাহতি ইগফিরলী।’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি: ৩৬২০)
ইফতারের আগে বেশি বেশি ইস্তেগফার করুন
উপরের দোয়াটিও ইস্তেগফারের দোয়া। পাশাপাশি ইস্তেগফারের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট এই দোয়াটি পড়বেন- أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ উচ্চারণ: ‘আস্তগফিরুল্লা হাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলায়হি।’ অর্থ: ‘আমি সেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি যিনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর এবং আমি তাঁর কাছে তওবা করছি।’ (আবু দাউদ: ১৫১৭, তিরমিজি: ৩৫৭৭)
বিজ্ঞাপন
ছোট্ট এই দোয়াটিও পড়তে পারেন- أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتوبُ إِلَيْهِ উচ্চারণ: ‘আসতাগফিরুল্লাহা ওয়া আতূবু ইলাইহি।’ অর্থ: ‘আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁর নিকট তাওবা করছি।’ আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-এর চেয়ে আর কাউকে এটি অধিক পরিমাণে পড়তে দেখিনি।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান: ৯২৮)
আরও পড়ুন: সবসময় ইস্তেগফার কেন করবেন
ইফতারের আগমুহূর্তে জিকির ও দরুদ
আল্লাহর জিকির ও দরুদ যেকোনো সময়ের জন্য দামী আমল। কিন্তু রোজার সময় বিশেষ করে ইফতারের আগে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তাই যতটা সম্ভব কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিকির করুন এবং নবীজির প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করুন।
দরিদ্র প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনকে ইফতার করান
ইফতারের সময় দরিদ্র প্রতিবেশীর কথা ভুলে যাবেন না। আপনি মজাদার ও দামী দামী ইফতার করবেন, আর পাশের দরিদ্র পরিবারটি ইফতার করবে না—বিষয়টি আল্লাহ কীভাবে নেবেন একটু চিন্তা করে দেখুন। রমজান হলো সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস। ইফতারি শুধু নিজের জন্য নয়, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়। তাদের ইফতারি খাইয়ে অফুরন্ত সওয়াব পাওয়া যায়। জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি (রা.) বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সাওম পালনকারীকে ইফতার করায় তার জন্য আছে তাদের অনুরূপ সাওয়াব। আর এতে তাদের কারো সওয়াবের কিছু কম হবে না।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৬)
ইফতার করার সময়
সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হয় এবং আজান দিতে হয়। সাবধানতার ক্ষেত্রে আজান শুনে ইফতার করা হয়। মূলত সূর্য ডুবে গেলেই ইফতারের সময় শুরু হয়ে যায়। ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেন, ‘যখন রাত সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে এবং দিন এদিক থেকে ওদিক চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায় তখন রোজার ইফতার করবে।’ (বুখারি: ১৮৩০)
দ্রততম সময়ে ইফতার করুন
ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হয়। বিনা কারণে বিলম্ব করা সুন্নাতের পরিপন্থী। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘লোকেরা যত দিন ওয়াক্ত হওয়া মাত্র ইফতার করবে তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।’ (বুখারি: ১৮৩৩; মুসলিম: ২৪২৫)
যথাসময়ে ইফতারকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমার কাছে প্রিয়তম বান্দা সে যে অবিলম্বে ইফতার করে। (তিরমিজি: ৭০০)
আরও পড়ুন: রমজানে দোয়া কবুলের বিশেষ ৩ সময়
ইফতারের শুরুতে এই দোয়া পড়ুন
দোয়ার মাধ্যমে ইফতার খাওয়া শুরু করতে হয়। মুআজ ইবনে জোহরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইফতারের সময় এই দোয়া পড়তেন— اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَ عَلَى رِزْقِكَ اَفْطَرْتُ ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।’ (আবু দাউদ: ২৩৫০, মুজামুল আওসাত: ৭৫৪৯)
ইফতার করার নিয়ম
পানি এবং খেজুর দ্বারা ইফতার শুরু করা সুন্নত। খাবারের অন্যান্য সুন্নাত এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইফতারে ভাজাপোড়ার পরিবর্তে দেশীয় ফলমূল খাওয়া উত্তম। সালমান ইবনে আমির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যদি ইফতার করে, তবে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। ইবনে উয়াইনা একটু বর্ধিত করেছেন, ‘এতে বরকত আছে। কেউ যদি তা না পায়, তবে সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কেননা পানি অতি পবিত্র।’ (তিরমিজি: ৬৯৫; আবু দাউদ: ২৩৪৭)
ইফতার শেষে এই দোয়া পড়ুন
রাসুল (স.) ইফতার শেষে এ দোয়া পাঠ করতেন— ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ উচ্চারণ: ‘জাহাবাজ জামাউ ওয়াব তাল্লাতিল উরুকু ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশা-আল্লাহু।’ অর্থ: ‘(ইফতারের মাধ্যমে) পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।’ (আবু দাউদ: ২৩৫৭)
অন্য কারো ঘরে ইফতার করলে এ দোয়া পড়ুন
أَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَأَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُونَ উচ্চারণ: ‘আকালা ত্বাআমাকুমুল আবরারু, ওয়া সাল্লাত আলাইকুমুল মালায়িকাতু, ওয়া আফত্বারা ইংদাকুমুস সায়িমুন।’ অর্থ: ‘তোমাদের খাদ্য হতে নেক্কার লোকেরা আহার করুক, ফেরেশতারা তোমাদের জন্য ইস্তেগফার করুক এবং রোজাদাররা তোমাদের কাছে ইফতার করুক।’ (শারহুস সুন্নাহ: ৩৩২০, সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি: ১৫০৬৯, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাজজাক: ১৯৪২৫)