প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য রমজানের রোজা রাখা ফরজ। রমজানের রোজা নিয়ে নারীদের জন্য কিছু স্বতন্ত্র মাসয়ালা রয়েছে। সেগুলো জেনে নেওয়া জরুরি। এখানে রমজানের রোজা সংক্রান্ত নারীদের প্রয়োজনীয় মাসায়েল তুলে ধরা হলো।
রোজা অবস্থায় পিরিয়ড শুরু হলে করণীয়
রোজা অবস্থায় পিরিয়ড শুরু হলে রোজা ভেঙে যায়। এমন নারীর জন্য খাওয়াদাওয়া করা বৈধ। তবে ওই দিন সম্ভব হলে রোজাদারদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া: ৪/১৯০)
বিজ্ঞাপন
ফজরের আগে পিরিয়ড শুরু হলে করণীয়
কোনো নারীর যদি ফজরের আগেই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়, ওই নারীর জন্য দিনের বেলা খাওয়াদাওয়া করা বৈধ। তবে গোপনে পানাহার করা উচিত। (আহসানুল ফতোয়া: ৪/৪২৮)
দিনের বেলা পিরিয়ড বন্ধ হলে করণীয়
পিরিয়ডের কারণে রোজা না রেখে দিন শুরু করার পর পিরিয়ড বন্ধ হলে দিনের বাকি অংশ রোজাদারদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পানাহার বর্জন করবে। কিন্তু এ দিনের রোজাও পরে কাজা করে নিতে হবে। (আহসানুল ফতোয়া: ৪/৪২৮; বাহুরুর রায়েক: ২/২৯১)
আরও পড়ুন: রমজানে নারীরা যেসব আমলে মনোযোগী হবেন
ফরজ গোসল ও পিরিয়ড নিয়ে সতর্কতা
রমজান মাসে রাতে গোসল ফরজ হলে গোসল না করেও দিনে রোজা রাখা বৈধ। গোসল না করায় রোজার ক্ষতি হবে না। তবে ফরজ গোসলে বিলম্ব করা অনুচিত। নারী যদি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী বুঝতে পারে যে আগামীকাল তার মাসিক শুরু হবে, তবু সে রোজা ভাঙবে না, যতক্ষণ না সে তার পিরিয়ডের রক্ত দেখতে পায়। (আপকে মাসায়েল: খ. ৩, পৃ. ২৭৮)
বিজ্ঞাপন
ফরজ গোসলে মহিলাদের লজ্জাস্থানের বহিরাংশে পানি পৌঁছালে ফরজ আদায় হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ অংশে পানি পৌঁছানো জরুরি নয়। আর রোজা অবস্থায় মহিলাদের ভেতরাংশে যেন পানি না পৌঁছে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, কেননা ভেতরে যাওয়ার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে। (রদ্দুল মুহতার: ১/১৫২)
ঋতুস্রাব ১০ দিনের বেশি হলে করণীয়
ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী একজন নারীর ঋতুস্রাবের সর্বনিম্ন সময় তিনদিন আর সর্বোচ্চ সময় ১০ দিন। তিন দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে মাসিক ঋতুস্রাবকালীন নামাজ-রোজা করার প্রয়োজন নেই। এই দিনগুলোতে নারীর যথাসাধ্য বিশ্রাম দরকার। এজন্য ওই দিনগুলোতে ইসলাম নারীকে নামাজ-রোজা থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে। কোনো কারণে ঋতুস্রাবের সময় ১০ দিনের চেয়ে বেড়ে গেলে নিজের আগের অভ্যাস অনুপাতে যে মেয়াদ আছে, ওই দিন পর্যন্ত বন্ধ রেখে এরপর থেকে নামাজ-রোজা পালন করবে। আর যদি ১০ দিনের ভেতরই শেষ হয়ে যায়, তাহলে শুরু ও শেষ দিন পর্যন্ত ঋতুস্রাব গণ্য করে নামাজ-রোজা বন্ধ রাখবে। এ অবস্থায় নামাজের কাজা না থাকলেও পরবর্তী সময়ে রোজা কাজা করে নেবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ১/৩০০-৩০১)
আরও পড়ুন: রমজানে পিরিয়ডের দিনগুলোতে নারীরা কি রোজার সওয়াব পান?
গর্ভাবস্থায় রোজা
অন্তঃসত্ত্বা নারীকে যদি কোনো মুসলমান পরহেজগার অভিজ্ঞ ডাক্তার বলেন, রোজা রাখলে তার নিজের বা গর্ভের বাচ্চার প্রাণনাশের বা মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে সেই নারী রোজা নাও রাখতে পারেন। পরে শুধু কাজা করে নিলেই হবে। (তিরমিজি: ১/১৫২; হেদায়া: ১/২২২; বাদাইউস সানায়ে: ২/২৫০)
স্তন্যদানকারিণীর রোজা
স্তন্যদানকারিণীর রোজার বিষয়টিও অনেকটাই অন্তঃসত্ত্বার রোজার মতো। অর্থাৎ স্তন্যদানকারিণী রোজা রাখলে যদি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে, তাহলে তিনি রোজা না রাখতে পারেন। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।
ওষুধ খেয়ে ঋতুস্রাব বন্ধ করে রোজা রাখার বিধান
পিরিয়ড অবস্থায় নামাজ মাফ। আর রোজা পিরিয়ড অবস্থায় রাখা নিষেধ। এ রোজা না রাখাতে তাদের কোনো গুনাহ নেই। তবে পরে তা কাজা করতে হয়। এজন্য রমজান মাসে পিরিয়ড হলে তা নিয়ে মনোক্ষুণ্ন হওয়ার কারণ নেই। তবে কেউ যদি শুরু হওয়ার আগেই ওষুধ বড়ি খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রেখে রোজা রাখেন তবে সে রোজা সহিহ হয়ে যাবে। ফলে তা আর পরে কাজা করতে হবে না। (ফতোয়ায়ে শামি: ১/৫০৮; আলমগিরি: ১/৩৮; ফাতহুল কাদির: ১/১৪৫)
ঋতুবতী নারীর জন্য উত্তম হলো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা এবং আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা। ওষুধ ব্যবহার করে রক্ত বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই। কেননা ইসলামের মহীয়সী সব নারী এমনটিই করেছেন। তবে যদি ওষুধ দিয়ে রক্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে রোজা রাখা যাবে এবং রোজা হয়ে যাবে। (আপকে মাসায়েল: খণ্ড ৩, পৃ. ২০৭)
আরও পড়ুন: নারীদের ইতেকাফের বিধান
সন্তান প্রসবের কতদিন পর রোজা রাখতে হবে
সন্তান জন্মদান পরবর্তী স্রাব থেকে নারীরা যদি ৪০ দিন হওয়ার আগেই পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে রোজা রাখবে এবং নামাজ আদায়ের জন্য গোসল করে নেবে। আর যদি ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও স্রাব অব্যাহত থাকে, তাহলে সে রোজা রাখবে এবং গোসল করে নেবে। কেননা তার রক্ত ইস্তেহাজা (রোগবিশেষ) হিসেবে গণ্য করা হবে। (বেহেশতি জেওর, পৃষ্ঠা-১৬০; শরহে বেকায়া, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা-১২০)
রোজা অবস্থায় শিশুকে দুধ পান করানোর বিধান
রোজা অবস্থায় শিশুকে দুধ পান করালে রোজা ভঙ্গ হয় না। (ফতোয়া দারুল উলুম: ৬/৪০৮)
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও রোজা না রাখলে শরিয়তের বিধান
কোনো মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কথা লজ্জায় মা-বোনের কাছে প্রকাশ না করে এবং রোজাও না রাখে; তাহলে তার ওপর তাওবা করা ও ছুটে যাওয়া রোজার কাজা করা ওয়াজিব। কারণ যে মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন হয়, সে নারী হোক বা পুরুষ তার ওপর রমজানের রোজা ফরজ।
অপবিত্র অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াতের বিধান
নারীদের অপবিত্র থাকার সময়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কোরআন তেলাওয়াত ও মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা বিভিন্ন দোয়া-দরুদ, তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার করতে পারবে। এমনকি দোয়া হিসেবে আয়াতুল কুরসি ও কোরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করা যাবে। এতে সওয়াব পাওয়া যাবে। ওই সময়ে দোয়ার অর্থবহ আয়াত বা সুরা দোয়ার নিয়তে পড়া জায়েজ। যেমন দোয়ার নিয়তে আয়াতুল কুরসি বা সুরা নাস ও ফালাক ইত্যাদি পড়া জায়েজ হবে। (ফাতহুল কাদির: ১/১৬৮, রদ্দুল মুহতার: ১/১৭২, আহসানুল ফতোয়া: ২/৭১)
লিপস্টিক-লিপজেল ব্যবহারে সতর্কতা
রোজা অবস্থায় নারীরা লিপস্টিক বা লিপজেল ব্যবহার করতে পারবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন মুখে চলে না যায়। যদি মুখে চলে যায় তবে রোজা মাকরুহ হবে। গলায় স্বাদ অনুভব হলে রোজা ভেঙে যাবে। (কিতাবুল ফতোয়া: ৩/৩৯৮)