ভালবাসা আল্লাহর নেয়ামত। এ কথা সত্য। তা না হলে মানুষ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে পারতো না। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন বলতে কিছুই থাকতো না। একজনের প্রতি আরেকজনের দয়া ও ভালোবাসা না থাকার কারণে সমাজ নষ্ট হয়ে যেত। তাই আল্লাহ তাআলা মেহেরবানি করে মানুষের অন্তরে ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ বলেন— ‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহে মহব্বত পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে।’(আলে ইমরান: ১০৩)
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ভালোবাসা আর ‘ভালোবাসা দিবস উদযাপন’ এক কথা নয়। ভ্যালেন্টাইন নামক একজন পাদ্রির মৃত্যুদণ্ডের সাথে এ উৎসবটি সম্পৃক্ত। অনেকের সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগে তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে ২৬৯ সালে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। পরে ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউ ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেছিলেন। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
ইসলামি শরিয়তে এই উৎসব উদযাপন জায়েজ নেই। কেননা, ইসলামে উৎসব দিবস হিসেবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজাহা এ দুটি দিবসই স্বীকৃত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে, তারা দুদিনে খেলাধুলা-উৎসব পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা কররেন, ‘এ দুটি কীসের দিবস? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগ থেকে এ দুদিনে উৎসব পালন করে আসছি। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ দুদিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন, তা হলো- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন (আবু দাউদ: ১১৩৪; মেশকাত: ১৪৩৯)
আরও পড়ুন: মেয়ের বিয়ে দিতে ছেলের ২ গুণ অবশ্যই দেখবেন
তাছাড়া বিধর্মীদের কৃষ্টি-কালচারের সাথে মিলে যায়—এমন যেকোনো উৎসব উদযাপন নাজায়েজ। ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত’ (আবু দাউদ: ৪০৩১; মেশকাত: ৪৩৪৭)
বিজ্ঞাপন
আর এই দিবস মূলত ব্যভিচারের পথ খুলে দেয় যা ইসলামে হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জেনার ধারে কাছে যেয়ো না। নিশ্চয় এটি অশ্লিল ও বেহায়াপনার কাজ ও নিকৃষ্ট পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১৭/৩২)
ভালোবাসা দিবস উদযাপনের নামে বেহায়পনা মুসলিম সমাজ ছড়িয়ে পড়লে আল্লাহর শাস্তির আশংকা রয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান, পরে তারা তারই ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, যার অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দিবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনু মাজাহ, কিতাবুল ফিতান: ৪০০৯)
আরও পড়ুন: নারীর যে গুনাহের দায় স্বামীকে বহন করতে হবে
ভালোবাসা দিবস উদযাপন জায়েজ কি না—এমন প্রশ্নে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য তাদের (বিধর্মীদের) উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনোকিছুর ক্ষেত্রে সাদৃশ্য গ্রহণ করা জায়েজ নয়। যেমন, খাবার দাবার, পোশাকাদি, গোসল, আগুন জ্বালানো অথবা এ উৎসবের কারণে কোনো অভ্যাস বা ইবাদত বর্জন করা ইত্যাদি। এবং কোনো ভোজানুষ্ঠান করা, উপহার দেওয়া অথবা এ উৎসব বাস্তবায়নে সহায়ক এমন কিছু বেচাবিক্রি করাও জায়েজ নয়। অনুরূপভাবে তাদের উৎসবে শিশুদেরকে খেলতে যেতে দেওয়া এবং সাজসজ্জা প্রকাশ করা জায়েজ নয়। মোদ্দাকথা, বিধর্মীদের উৎসবের নিদর্শন—এমন কিছুতে অংশ নেওয়া মুসলমানদের জন্য নাজায়েজ। বরং তাদের উৎসবের দিন মুসলমানদের নিকট অন্য সাধারণ দিনের মতোই। মুসলমানেরা এ দিনটিকে কোনভাবে বিশেষত্ব দিবে না।’ (মাজমুউল ফতোয়া: ২৯/১৯৩)
শায়খ উসাইমীনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, তিন কারণে ভালোবাসা দিবস পালন নাজায়েজ। ১. এটি একটি বিদআতি উৎসব; শরিয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই। ২. এটি মানুষকে অবৈধ প্রেম ও ভালবাসার দিকে আহ্বান করে। ৩. এ ধরনের উৎসব মানুষের মনকে সলফে সালেহিনদের আদর্শের পরিপন্থী অনর্থক কাজে ব্যতিব্যস্ত রাখে। সুতরাং এ দিনের কোনো একটি নিদর্শন ফুটিয়ে তোলা জায়েজ হবে না। সে নিদর্শন খাবার-পানীয়, পোশাকাদি, উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি যেকোনোকিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট হোকনা কেন। মুসলমানের উচিত তার ধর্মকে নিয়ে গর্ববোধ করা। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেওয়া। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে প্রকাশ্য ও গোপন সকল ফিতনা থেকে হেফাজত করেন এবং তিনি যেন আমাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন, আমাদের তাওফিক দান করুন। (শাইখ উসাইমীন ফতোয়াসমগ্র: ১৬/১৯৯)
আরও পড়ুন: বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা জায়েজ?
ভালোবাসা পবিত্র বিষয়। বিশ্বব্যাপী এ ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে এমন দিবস উদযাপনের আদৌ প্রয়োজন নেই, যে দিবসের সূচনাই হয়েছিল অবৈধ প্রেমকে প্রমোট করার জন্য। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের সেই পাদ্রিকে যখন বন্দি করা হয়, বন্দি অবস্থায়ও সে কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে অবৈধ সম্পর্ক ছাড়া ছাড়েনি। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। মুসলমানরা এখান থেকে ভালোবাসার শিক্ষা নিতে পারে না। বরং এটি বেহুদা কাজ। মুসলমানরা ভালোবাসবে নিজের স্ত্রীকে। এজন্যই ইসলামে বিয়ের উপযুক্ত হওয়ার সাথেসাথে বিয়ে করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—‘হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিবাহ করে নেয়। কারণ, বিবাহ চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।’ (বুখারি: ৫০৬৬; মুসলিম: ১৪০০)
রাসুল (স.) আরও ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর দিকে দয়া ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায় তাহলে আল্লাহ তাআলা তার দিকে দয়া ও রহমতের দৃষ্টি নিয়ে তাকান।’ এই হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, তাদের প্রতি রহম করা ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেক স্ত্রীই তার স্বামীর কাছে ভালোবাসা চায়। স্বামীদের উচিত, স্ত্রীদের ভালোবাসা ও তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। আল্লাহ আমাদের সবরকম গুনাহের কাজ থেকে হেফাজত করুন। শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। আমিন।