হিজাব বা পর্দা অর্থ আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, গোপন করা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, অশ্লীলতা ও ব্যভিচার নিরসনের লক্ষ্যে নারী-পুরুষ উভয়েরই তাদের নিজ নিজ রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্যকে একে অপর থেকে আড়ালে রাখার জন্য ইসলাম যে বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছে, তাকে হিজাব বা পর্দা বলা হয়। (আল মুজামুল ওয়াসিত: ১/১৫৬)
পর্দা ইসলামের অপরিহার্য বিধান। কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে এটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)
বিজ্ঞাপন
মুমিন নারী হয়ে যারা পর্দার বিধান মেনে চলে না, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। (তিরমিজি: ১১৭৩) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারাই, যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে।’ (বায়হাকি: ১৩২৫৬)
ছয় শর্ত মেনে পর্দা করা জরুরি।
১. মুখসহ গোটা শরীর ঢেকে রাখা: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। (সুরা আহজাব: ৫৯) এই আয়াতে জিলবাব বলতে বোঝানো হয়- যা নারীরা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকতে ব্যবহার করে। (লিসানুল আরাব: ১/২৭৩) মুফাসসিররাও বলেছেন- জিলবাব অর্থ এমন বড় চাদর, যা দ্বারা মুখমণ্ডল ও পূর্ণ দেহ আবৃত করা যায়। (কুরতুবি, আল-জামে লিআহকামিল কুরআন: ১৪/২৪৩)
আরও পড়ুন: স্বামীর সামনে সতর খুলে রাখা জায়েজ?
২. পরিহিত বোরকা জাঁকজমকপূর্ণ ও ফ্যাশনমূলক না হওয়া: পর্দাপালনে বোরকা বা অন্যকোনো কাপড় যেন এমন না হয়, যাতে পরপুরুষের আকর্ষণ তৈরি হতে পারে। পর্দার কারণে পুরুষ যদি উল্টো ওই নারীকে কামনা করে বসে, তাহলে নিশ্চয়ই তা দ্বারা হিজাবের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। তাই ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, অতি ঝিকঝাকপূর্ণ বা ফ্যাশনমূলক বোরকা পরা যাবে না।
বিজ্ঞাপন

৩. বোরকার কাপড় মোটা হওয়া, যাতে শরীরের আকৃতি অনুধাবন করা না যায়: হাদিসে এসেছে, শেষ জামানায় এমন কিছু নারী আসবে যারা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ। তাদের মাথার উপরে থাকবে খোরাসানি উটের কুঁজের মতো (অর্থাৎ তারা নিজেদের চুলের সাথে অন্য কাপড় বা পাগড়ি বেঁধে মাথাকে বড় করে ফুটাবে)। তোমরা তাদেরকে লানত করো। কেননা তারা লানতের উপযুক্ত। অন্য এক রেওয়ায়েতে বর্ধিত অংশ হচ্ছে: তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতের সুবাসও পাবে না; যদিও জান্নাতের সুবাস এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে। এটি সহিহ মুসলিমের আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিস। ইবনে আব্দুল বার বলেন, হাদিসে নবী (স.) বুঝিয়েছেন, যে সব নারী এমন হালকা কিছু পরিধান করে যা শরীরকে আচ্ছাদিত না করে ফুটিয়ে তোলে; এমন নারীরা নামেমাত্র পোশাক পরিহিতা, প্রকৃতপক্ষে এরা উলঙ্গ। (সুয়ুতি তানওয়িরুল হাওয়ালিক: ৩/১০৩)
৪. বোরকা ঢিলেঢালা হওয়া: দেহের মূল কাঠামো যেন প্রকাশ না পায়, সেজন্য বোরকা ঢিলেঢালা হওয়া পর্দা শুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত। কেননা, আঁটসাঁট পোশাক যদিও শরীর ঢেকে রাখে, কিন্তু এর দ্বারা নারী-দেহের স্পর্শকাতর অংশ বোঝা যায় এবং পুরুষের চোখে মোহ জাগায়। আল্লাহ বলেছেন- وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ ‘তারা যেন তাদের সজ্জা প্রকাশ না করে।’ (সুরা নূর: ৩১) অন্যত্র বলেছেন- وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى ‘আর মূর্খতাযুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।’ (সুরা আহজাব: ৩৩)
৫. পুরুষের পোশাকের সাদৃশ্যপূর্ণ না হওয়া: পোশাক-আশাকে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারীকে লানত করা হয়েছে বিভিন্ন হাদিসে। এক হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (স.) মহিলার পোশাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোশাক পরিধানকারী নারীকে লানত করেছেন।’ (আবু দাউদ: ৪০৯৮)
আরও পড়ুন: নারীদের মতো লম্বা চুল রাখা জায়েজ?
৬. অমুসলিম নারীদের পোশাকের সাদৃশ্যপূর্ণ না হওয়া: এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- لَيْسَ مِنَّا مَنْ [ص:تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ وَلَا بِالنَّصَارَى ‘যে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য বা মিল রেখে চলে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, তোমরা ইহুদি ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রেখো না। (চাল-চলন, বেশ-ভূষায় তাদের অনুকরণ করো না)। (তিরমিজি: ২৬৯৫)
বৃদ্ধাবস্থায় পর্দা পালনে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতিশয় বৃদ্ধ নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের অতিরিক্ত বস্ত্র খুলে রাখে। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর: ৬০) আয়াতের নির্দেশনা হলো- বৃদ্ধা নারীর প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করে না এবং সে বিবাহেরও যোগ্য নয় তার জন্য পর্দার বিধান শিথিল করা হয়েছে। গায়রে মাহরাম ব্যক্তিও তার কাছে মাহরামের মতো হয়ে যায়। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন: খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা-৪৩৯)
উল্লেখ্য, নামাজের সময় হাত, পা, মুখ ছাড়া পূর্ণ শরীরই সতর। অন্য সময় গায়রে মাহরামের সামনে নারীর পূর্ণ শরীরই সতর। তবে অতীব প্রয়োজনে চেহারা, পা ও হাত খোলা জায়েজ আছে। যেমন—রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় হলে, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি। (ফতোয়ায়ে শামি: ১/৪০৬, ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ৪/১০৬) মাহরামদের সামনে নারীদের সতর হলো মাথা, চুল, গর্দান, কান, হাত, পা, টাখনু, চেহারা, গর্দানসংশ্লিষ্ট সিনার ওপরের অংশ ছাড়া বাকি পূর্ণ শরীর। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩২)

