শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এক জান্নাতি নারীর দুটি অনন্য ঘটনা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২২, ১২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

এক জান্নাতি নারীর দুটি অনন্য ঘটনা
প্রতীকী ছবি

হজরত রুমাইছা বিনতে মিলহান আনসারিয়া (রা.)। উপনাম উম্মে সুলাইম এবং এ নামেই তিনি অধিক প্রসিদ্ধ। তিনি বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আনাস বিন মালিক (রা.)-এর মা। নবী কারিম (স.) ইরশাদ করেছেন, স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ কারো নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হলেন রুমাইছা বিনতে মিলহান, আনাস ইবনে মালিকের আম্মা। (সহিহ মুসলিম: ২৪৫৬; মুসনাদে আহমদ: ১১৯৫৫)

হজরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম জান্নাতে প্রবেশ করেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে আবু তালহার স্ত্রী রুমাইছা।’ (সহিহ বুখারি: ৩৬৭৯; মুসনাদে আহমদ: ১৫০০২; সহিহ ইবনে হিববান: ৭০৮৪; সুনানে নাসায়ি কুবরা: ৮১২৪)

উম্মে সুলাইম তাঁর জীবন, সন্তান ও পরিবার আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সেবায় নিয়োজিত করেন। তিনি অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী সাহাবীদের মধ্যে তিনিও একজন। প্রথম স্বামী মালিক বিন নজর উম্মে সুলাইম (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণে অসন্তুষ্ট হয়ে শামে চলে যান; আর কখনো ফিরে আসেননি, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। প্রথম স্বামীর ঔরসে আনাস (রা.)-এর জন্ম হয়। (আসাদুল গাবাহ: ৩৪৫/৭)

আনাস (রা.) বলেন, `রাসুল (স.) যখন মদিনায় আসেন তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। মা আমার হাত ধরে রাসুল (স.)-এর কাছে নিয়ে যান। মা রাসুল (স.)-এর কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আনসারের সব নারী ও পুরুষ আপনাকে কোনো না কোনো কিছু হাদিয়া দিয়েছে। আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই। আমার কাছে কেবল আমার ছেলে আছে। আপনি ওকে হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করুন, সে আপনার প্রয়োজনের সময় খেদমত করবে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৪৮০)

প্রথম ঘটনা মোহরানা সংক্রান্ত

স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকেই উম্মে সুলাইম (রা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আবু তালহা আনসারি তাঁদের একজন। তবে তিনি তখনো কাফের। অমুসলিম হওয়ায় উম্মে সুলাইম (রা.) তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও মানুষ হিসেবে তিনি পছন্দনীয় ছিলেন। তিনি তাঁকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করলে সেটাই হবে আমার মোহরানা। তা ছাড়া আর কিছুই আমি চাই না।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ: ৪২৬/৮)


বিজ্ঞাপন


উম্মে সুলাইম (রা.)-এর আহ্বান আবু তালহার পছন্দ হয় এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু তালহার ইসলাম গ্রহণ ও তাঁদের বিয়ে আরবে আলোচনার সৃষ্টি করে। বলা হয়, ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান মোহর।

মায়ের বিয়ে প্রসঙ্গে আনাস (রা.) বর্ণিত আছে, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হজরত আবু তালহা উম্মে সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রতিউত্তরে উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, আপনি কি জানেন, আপনি যে উপাস্যের পূজা করেন, তা জমি থেকে উৎপন্ন? (মাটি, গাছ ও খড়কুটা দিয়ে তৈরি) তিনি বললেন, হ্যাঁ। উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, গাছ-গাছালির পূজা করতে আপনার কি লজ্জা করে না? আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আপনি যদি আমার ধর্মের অনুসরণ করেন, তবেই আমি আপনাকে বিয়ে করব। আপনার ইসলাম গ্রহণ করাটাই হবে আমার মোহর। আমি এছাড়া আর কোনো মোহর চাই না। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি। তারপর তিনি ফিরে এসে বললেন, আমিও আপনার ধর্মের অনুসারী। কালেমা পড়ে তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন এবং উম্মে সুলাইমকে বিবাহ করেন। (সুনানে নাসায়ে: ৩৩৪০; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ১০৪১৭)

দ্বিতীয় ঘটনা ছেলের মৃত্যুতে সবর করা সংক্রান্ত

হাদিস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তাঁর বীরত্ব, সাহসিকতা, ধার্মিকতা ও প্রজ্ঞার যেমন অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তেমনি মসিবতের সময় তাঁর ধৈর্য্যশীলতাও দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। ইমাম বুখারি (রহ) তার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারিতে তাঁর এই ঘটনার শিরোনাম করেছেন ‘মসিবতের সময় যিনি তার মর্মবেদনা প্রকাশ করেন না।’ তার সেই ঘটনার বিবরণ এরূপ-

হজরত আবু তালহার সঙ্গে উম্মে সুলাইমের বিয়ে হওয়ার পর তাদের খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় উমাইর। তার ছোট একটি পাখিও ছিল, যার সাথে সে খেলত। রাসুলুল্লাহ (স.) মাঝেমধ্যে সেই শিশুটির সাথে কৌতূক করতেন এবং বলতেন, হে উমাইর! তোমার বুলবুলির কী খবর!’

একদিন ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। আবু তালহা (রা.) এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি অস্থির হয়ে পড়লেন। তার অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে আসা যাওয়া করতেন। এক বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। ইত্যবসরে তার অসুস্থ ছেলে মৃত্যুবরণ করল। এতে উম্মে সুলাইম (রা.) খুব ব্যথিত হলেও সবর করলেন। ছেলেকে গোসল করালেন, কাফন পরালেন, সুগন্ধি মেখে দিলেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে ঘরের এক কোণে সুন্দরভাবে শুইয়ে রাখলেন। আর হজরত আনাস (রা.)-কে পাঠিয়ে হজরত আবু তালহাকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে বলে দিলেন আবু তালহাকে যেন মৃত্যুসংবাদ না জানায়।

আবু তালহা (রা.) সেদিন রোজা রেখেছিলেন। উম্মে সুলাইম (রা.) তার জন্য খানা তৈরি করলেন। আবু তালহা (রা.) ঘরে ফিরেই সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। উম্মে সুলাইম বললেন, সে এখন আগের চেয়ে শান্ত। ক্লান্ত স্বামীকে তৎক্ষণাৎ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ জানালেন না। ঘরের লোকদেরকেও নিষেধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়। আবু তালহা (রা.) তার কথা শুনে ভেবেছিলেন ছেলে তাঁর সুস্থ হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার খেলেন এবং বিশ্রাম নিলেন। এমনকি ভোরে গোসলও করলেন।

হজরত আবু তালহা (রা.) বের হওয়ার আগে উম্মে সুলাইম (রা.) তাকে বললেন, বলুন কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখে অতপর তার কাছে তা ফেরত চায়, তবে তার কি অধিকার আছে তা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখার? আবু তালহা (রা.) বললেন, না, তার এ অধিকার নেই। তখন হজরত উম্মে সুলাইম এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন, তারপর তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন। আবু তালহা (রা.) এতে (খুবই কষ্ট পেলেন এবং) রাগান্বিত হলেন। রাতে উম্মে সুলাইমের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট স্ত্রীর নামে অভিযোগ করলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তাদের ঘটনা শুনে বিমুগ্ধ হলেন এবং দোয়া করলেন- ‘আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন।’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবদুল্লাহ নামে আরেকটি পুত্র সন্তান দান করলেন। সেই আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহাকে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সাত পুত্র দান করলেন, যাদের প্রত্যেকেই কোরআনের আলেম হয়েছেন। (সহিহ বুখারি: ১৩০১; মুসনাদে আহমদ: ১২০৮; ফাতহুল বারী: ৩/২০১)

উম্মে সুলাইমের উক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ) উপরোক্ত হাদিসের অনেক ফাওয়ায়েদ উল্লেখ করেছেন। প্রথমে তিনি উম্মে সুলাইমের বৈশিষ্ট্য ও মহত্ব বর্ণনা করেছেন যে, তিনি উক্ত ঘটনার মাধ্যমে তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা ও নেক গুণাবলির পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে স্বামীকে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে তাকে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছেন। সন্তানের মৃত্যুকে গচ্ছিত বস্তুর উদাহরণ দিয়ে শোকার্ত স্বামীকে যেমন সান্ত্বনা দিয়েছেন তেমনি আল্লাহর ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তার উদ্দেশ্য ও নিয়তের সততা সম্পর্কে জ্ঞাত। তাই তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন এবং তিনি আল্লাহর রাসুলের বরকতের দোয়া লাভ করলেন। এক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয় হলো- আল্লাহ তাআলার ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া। বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করা এবং আল্লাহর কাছে উত্তম বিনিময় প্রত্যাশা করা। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহার করা। স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সকল নারীকে হজরত উম্মে সুলাইম (রা.)-এর উক্ত ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর