আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কিছু আমল নবীজির খুব প্রিয় ছিল। ওসব আমলের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে প্রিয় সাহাবিদেরও তিনি উৎসাহিত করতেন। নিচে তেমনই কিছু ফজিলতপূর্ণ আমল নিয়ে আলোচনা করা হলো, যেগুলো নবীজি ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে আদায় করতেন।
ফজরের দুই রাকাত সুন্নত
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম।’(সহিহ মুসলিম: ৭২৫) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘নবী (স.) কোনো নফল (ফরজ/ওয়াজিব নয় এমন) নামাজকে ফজরের দুই রাকাত সুন্নতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন না।’ (সহিহ বুখারি: ১১৬৯)
বিজ্ঞাপন
কোরআন শিক্ষা দেওয়া
নবী ও রাসুল হিসেবে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যে কয়টি মৌলিক দায়িত্ব ছিল, সেসবের মধ্যে অন্যতম- মানুষকে কোরআনের শিক্ষা প্রদান করা। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- ‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, যে তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট তেলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪) উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫০২৭)
আরও পড়ুন: প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত
আহার করানো ও সালাম দেওয়া
পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার জন্য মুসলমানদের পারস্পরিক মহব্বত ও ভালবাসা আবশ্যক। এজন্য ইসলামে আহার করানো ও সালাম দেওয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। নবীজি এ আমল দুটিকে বেশি পছন্দ করতেন। ‘আসহাবুস সুফফার (যারা মসজিদে নববীতে থাকতেন, তাদের বাড়ি-ঘর ছিল না) সদস্যরা ছিলেন রাসুল (স.) এর নিত্য মেহমান। তিনি তাদের খাতির-যত্নের কোনো কমতি রাখতেন না। অন্যান্য মেহমানদের তিনি আসহাবুস সুফফার সঙ্গে মসজিদে নববীতে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তাছাড়া সাহাবি রামলা ও উম্মে শরিক (রা.)-এর ঘরেও মেহমানদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। (শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা-৮০) মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় অতিথির কোনো অভাব ছিল না। রাসুল (স.) নিজেই তাদের খেদমত আঞ্জাম দিতেন। আর সাহাবি বেলাল (রা.)-কে রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। (সিরাতুন নবী, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা- ৫০৪) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (স.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, ইসলামের কোন আমলটি উত্তম? তিনি বলেন, ‘আহার করানো এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া।’ (সহিহ বুখারি: ২৮)
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা অথবা ঘৃণা করা
আবু জার (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ পোষণ করা অতি উত্তম কাজ।’ (আবু দাউদ: ৪৫৯৯) রাসুলুল্লাহ (স.) এ আমলকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। পবিত্র কোরআনেও এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমানের মোকাবেলায় কুফরকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে বস্তুত তারাই বড় নাফরমান।’ (সুরা তাওবা: ২৩)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসার পুরস্কার
পরিবারের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি তোমাদের মধ্যে আমার পরিবারের কাছে উত্তম।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৮৯৫) প্রিয়নবীজি স্ত্রীদের সকল চাওয়া পূর্ণ করতেন। কাউকে কখনও নবীজির আচরণে কষ্ট পেতে হয়নি। তিনি পরিবারের সঙ্গে অধিক কোমল আচরণ করতেন। এটি তিনি নিজের জন্য দায়িত্ব করে নিয়েছিলেন। কারণ এটিই পূর্ণ ঈমানেরই প্রমাণ। রাসুল (স.) বলেছেন, সবচেয়ে পরিপূর্ণ ঈমানদার ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে অধিক নরম ও কোমল হয়।’ (তিরমিজি: ২৬১২)
সংশয়মুক্ত ঈমান ও আমল
প্রিয়নবী (স.)-এর ঈমান ও আমল ছিল সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সংশয়মুক্ত। এজন্যই তাঁর অনুসরণ ছাড়া ঈমান ও আমল কোনোটাই বিশুদ্ধ হয় না। আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি খাসআমি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.)-কে প্রশ্ন করা হলো যে সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বলেন, ‘সংশয়মুক্ত ঈমান, খেয়ানতবিহীন জিহাদ এবং পাপমুক্ত হজ।’ (নাসায়ি: ২৫২৬)
তাকবিরে উলার সঙ্গে নামাজ আদায়
তাকবিরে উলার সঙ্গে (ইমামের প্রথম তাকবির) নামাজ আদায়ের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। এই আমলে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন জামাতে নামাজ আদায় করবে এবং সে প্রথম তাকবিরও পাবে তার জন্য দুটি মুক্তির পরওয়ানা লেখা হবে। (এক) জাহান্নাম থেকে মুক্তি। (দুই) নেফাক থেকে মুক্তি। (তিরমিজি: ১/৩৩; আত-তারগিব: ১/২৬৩)
আরও পড়ুন: ৪০ দিন জামাতে নামাজ পড়লে কী হয়
সুরা ফাতেহা শেষ হওয়ার আগে জামাতে শরিক হতে পারলেও কোনো কোনো ফকিহ তাকবিরে উলার সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেছেন। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৫৪; রদ্দুল মুখতার: ১/৫২৬)
দীর্ঘ নামাজ
নবীজির জীবনীতে দীর্ঘ নামাজের অনেক বর্ণনা রয়েছে। তাঁর নামাজে এতই একাগ্রতা ছিল যে, পা ফুলে যেত। এছাড়াও হালাল উপার্জন, সবরকম হারাম থেকে দূরে থাকা এবং জিহাদ তাঁর অনেক পছন্দের আমল ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি আল-খাসআমি (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল (সা.)-কে সর্বোত্তম কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কোন সদকা উত্তম? তিনি বলেন, ‘নিজ শ্রমে উপার্জিত সামান্য সম্পদ থেকে যে দান করা হয় সেটাই উত্তম।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন হিজরত উত্তম? তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকা।’ জিজ্ঞেস করা হলো কোন জিহাদ উত্তম? তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের জীবন ও সম্পদ মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।’ জিজ্ঞেস করা হলো, কোন ধরনের মৃত্যু মর্যাদাসম্পন্ন? তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (যুদ্ধের ময়দানে) নিজের ঘোড়াসহ নিহত হয়।’ (আবু দাউদ: ১৪৪৯)
তাহাজ্জুদ
তাহাজ্জুদ নামাজে বিশেষভাবে অভ্যস্থ ছিলেন নবীজির। এটি নবীজির প্রিয় আমল হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদের নামাজ’ (মুসলিম: ১১৬৩)। ঈমানদারের গুণাবলি বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগতপরায়ণ, আল্লাহর পথে ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
আরও পড়ুন: তাহাজ্জুদ অনুগত বান্দাদের ইবাদত
মেসওয়াক
মেসওয়াক প্রিয়নবী (স.)-এর প্রিয় একটি সুন্নত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এটি। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা, রবের সন্তুষ্টির মাধ্যম’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৮৯; সহিহ ইবনে হিব্বান: ১০৬৭)। অপর হাদিসে এসেছে, ‘আমাকে মেসওয়াকের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমার আশঙ্কা হতে লাগল, না জানি আমার ওপর তা ফরজ করে দেওয়া হয়।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৬০০৭)
মাসে তিন রোজা, চাশত ও বিতির নামাজ
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধু রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে তিনটি অসিয়ত করেছেন—এক. প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, দুই. দুই রাকাত চাশতের নামাজ পড়া, তিন. ঘুমের আগে বিতরের নামাজ পড়া।’ (সহিহ বুখারি: ১১৭৮)
হাদিসে তিন রোজা বলতে প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজাকে বুঝানো হয়েছে। এ রোজাকে বলা হয় আইয়ামে বিজের রোজা। আলোচ্য হাদিসে মহানবী (স.) তিনটি বিশেষ আমলের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসবিশারদরা বলেন, যদিও এ হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.)-কে সম্বোধন করা হয়েছে, তবু তা উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। সবার উচিত আমল তিনটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিয়মিত উপরোক্ত আমলগুলো ইখলাসের সঙ্গে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।