আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা অর্জনই মুমিন জীবনের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রধানত যেসব আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত, সেগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—
সর্বদা আল্লাহর স্মরণ
চলতে-ফিরতে, নানা কাজে আন্তরিকভাবে আল্লাহর স্মরণ বিশেষ মুমিনদের গুণ। এতে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ে। আল্লাহ তাআলাও তাদের স্মরণ করেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণা মোতাবেক আমি (আচরণ করি)। আমি তার সঙ্গে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে আমি তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। যদি সে আমাকে মজলিসে স্মরণ করে, আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক বাহু অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে আসে হেঁটে, আমি তার দিকে যাই দ্রুত।’ (বুখারি: ৭৪০৫)
বিজ্ঞাপন
নফল ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া
দিন-রাতের নফল নামাজ, নফল রোজা, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি নফল ইবাদতগুলো আবশ্যকীয় বিধান নয়। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, ‘আমি যা কিছু আমার বান্দার ওপর ফরজ করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। একপর্যায়ে আমি তাকে এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নিই যে আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে।’ (বুখারি: ৬৫০২)
আরও পড়ুন: ফরজ বাধ্যতামূলক, নফলে আল্লাহর নৈকট্য
পাপ থেকে বেঁচে থাকা
পাপ কাজ ছেড়ে দিলে আল্লাহ খুশি ও সন্তুষ্ট হন। পরকালীন শাস্তির কথা ভেবে ক্ষুদ্র পাপ থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করা উচিত। রাসুল (স.) আয়েশা (রা.)-কে বলেছেন, ‘হে আয়েশা, তুমি ছোট ছোট গুনাহ থেকেও নিজেকে রক্ষা করো। কেননা সেটা লেখার জন্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছেন।’ (মেশকাত: ৫৩৫৬)
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা
কোনো মুসলমানকে ভালোবাসার কারণেও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘এক ব্যক্তি তার কোনো (মুসলমান) ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওনা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। (ফেরেশতা তাকে বলেন) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস।’ (মুসলিম: ২৫৬৭)
বিজ্ঞাপন
আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া করা
সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন মুমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অত্যন্ত উঁচু ও মহৎ এই গুণের মাধ্যমে বান্দা ও প্রভুর সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের (আমার নিয়ামত) আরো বাড়িয়ে দেব, আর অকৃতজ্ঞ হলে (জেনে রেখো) আমার শাস্তি কঠোরতম।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)
আরও পড়ুন: আল্লাহর শুকরিয়ার মধ্যে যে প্রতিদান রয়েছে
কোরআনচর্চা
পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর কালাম। এটি মানুষকে আলোকিত করে। মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনে সাহায্য করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানরা যেন তা অনুধাবন করে।’ (সুরা সদ: ২৯)
আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির
অন্তরে সর্বদা আল্লাহর পবিত্র নাম ও তঁর অতুলনীয় গুণাবলীর জিকির আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাকো। আর তাদের বর্জন করো, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শিগগিরই পাবে।’ (সুরা আরাফ: ১৮০)
সর্বদা আল্লাহর মুখাপেক্ষিতা
আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী—এই অনুভূতি সর্বদা অন্তরে জাগ্রত রাখা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বড় সহায়ক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর অমুখাপেক্ষিতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (সুরা ফাতির: ১৫)
যেকোনো আমল নিয়মিত করা
যেকোনো আমল নিয়মিত করা আল্লাহ তাআলার পছন্দের। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘..মনে রেখো, আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে পছন্দের আমল হলো যা নিয়মিত করা হয় যদিও তা পরিমাণে হয় অল্প।’ (মুসলিম : ২৮১৮)
পুণ্যবানদের সাহচর্য ও জিকিরের মজলিসে অংশগ্রহণ
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না’ (সুরা কাহাফ: ২৮)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা যখন জান্নাতের বাগানগুলোর পাশ দিয়ে যাবে সে সময় সেখান থেকে পাকা ফল তুলে নেবে। লোকজন প্রশ্ন করল, জান্নাতের বাগানগুলো কী? তিনি বলেন, জিকিরের মজলিস।’ (তিরমিজি: ৩৫১০)
আরও পড়ুন: দলবদ্ধ জিকির কি বিদআত?
দ্বীনের ওপর অবিচল থাকা
যারা দ্বীনের ওপর অবিচল থাকবে, তাদের ব্যাপারে আছে সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, তারপর অবিচল থাকে, তাদের কাছে নাজিল হয় ফেরেশতা (এই বলে) যে তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার জন্য আনন্দিত হও।’ (সুরা ফুসসিলাত: ৩০)
মেসওয়াক করা
মেসওয়াক করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মেসওয়াক হলো মুখের পবিত্রতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। (সুনানে নাসায়ি: ৫)
বাবাকে খুশি রাখা
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, পিতার সন্তুষ্টির মধ্যেই রবের সন্তুষ্টি আর পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই রবের অসন্তুষ্টি রয়েছে। (তিরমিজি: ১৮৯৯)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী হওয়া
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয়, মানুষের দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ তাআলা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী হয় আল্লাহ তাকে মানুষের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। (তিরমিজি: ২৪১৪)
আরও পড়ুন: আল্লাহকে ভুলে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজার পরিণতি
বিপদাপদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, বিপদ যত মারাত্মক হবে প্রতিদান তত মহান হবে। আল্লাহ তাআলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন বিভিন্ন বালা-মসিবত দিয়ে তাদের পরীক্ষা করেন। সুতরাং যারা এর ওপর সন্তুষ্ট থাকে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যারা এর ওপর অসন্তুষ্ট থাকে তাদের জন্য রয়েছে মহান রবের অসন্তুষ্টি। (সুনানে তিরমিজি: ২৩৯৬)
সকাল-সন্ধ্যায় বিশেষ দোয়া পাঠ
প্রিয়নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, যে মুমিন বান্দা সকাল-সন্ধ্যা তিনবার এই দোয়া ‘রাদীতু বিল্লাহি রাব্বাওঁ ওয়াবিল ইসলামি দীনাওঁ ওয়া বি-মুহাম্মাদিন নাবিয়্যাওঁ ওয়ারাসূলা’ পাঠ করবে’ আল্লাহ তাআলা তাকে বিচার দিবসে অবশ্যই সন্তুষ্ট করে দেবেন। (আল আহাদ ওয়াল মাসানিলি আহমদ: ৪৭১)
তিনটি বিশেষ গুণ অর্জন
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের তিনটি কাজে সন্তুষ্ট হন এবং তিনটি কাজে অসন্তুষ্ট হন। যে তিন কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন তা হলো- ১. তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকেও শরিক করবে না। ২. আল্লাহর রজ্জু (কোরআন) মজবুত করে ধরবে। ৩. রাষ্ট্রপ্রধানকে নসিহত করবে। আর যে তিন কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন, তা হলো- ১. অধিক কথা বলা। ২. অপব্যয় করা। ৩. অধিক ভিক্ষা করা। (মুয়াত্তা মালেক: ১৮০৪)
উল্লেখিত কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিকশিত হবে এবং আমাদের মধ্যে গেঁথে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের তাওফিক দান করুন। আমিন।