আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। এমন ইবাদত আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য করতে মনোযোগ ধরে রাখার বিকল্প নেই। এরপরও অনেক সময় নানা চিন্তা চলে আসতে পারে। শয়তানও নামাজির মনে কুমন্ত্রণা দেয়। হাদিসের ভাষায়, শয়তান বলে ‘...এটা স্মরণ করো, ওটা স্মরণ করো, বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পোঁছে যে, সে কয় রাকাত নামাজ আদায় করেছে তা মনে করতে পারে না।’ (বুখারি: ৬০৮)
নামাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ ধরে রাখতে কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
বিজ্ঞাপন
নামাজে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা
নামাজ পড়ার সময় হাত-পা ও শরীরকে নামাজের বাইরের কোনো কাজে ব্যবহার না করা। এটা খুশুখুজুরই অংশ। অনর্থক নড়াচড়া থেকে বিরত থাকা। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, তোমাদের নবীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন সাতটি (অঙ্গের) উপর সেজদা করে এবং নামাজে চুল বা কাপড় না গুটায়। (আবু দাউদ: ২/১৪, হাদিস: ৮৮৬)
বিখ্যাত তাবেয়ি মুজাহিদ রাহ. বলেন, হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) যখন নামাজে দাঁড়াতেন তখন মনে হতো একটি কাঠ মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৭৩২২) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) যখন নামাজে দাঁড়াতেন তাকে দেখে মনে হত যেন একটি পড়ে থাকা কাপড়।’ (মুসান্নাফ আবদুর রাজজাক: ৩৩০৩)
আরও পড়ুন: সাহাবিরা যেভাবে নবীজি অনুসরণ করতেন
নামাজ পড়বেন যেন আল্লাহকে দেখছেন
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছো। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (বুখারি: ৫০; মুসলিম: ৮)
নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কল্পনা ধরে রাখলে মনোযোগ হারাতে হবে না ইনশাআল্লাহ।
বিজ্ঞাপন
বিশুদ্ধ উচ্চারণের চেষ্টা করা
বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের চেষ্টা নামাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা দৃঢ় করতে সহায়ক। অন্তত সুরা ফাতেহা ও তাসবিহগুলোর অর্থ বুঝে পড়ার চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন তেলাওয়াত করো।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ৪) হাদিসে এসেছে, রাসুল (স.) প্রতিটি সুরা তারতিলসহ তেলাওয়াত করতেন। (মুসলিম: ৭৩৩, তিরমিজি: ৩৭৩)
আল্লাহর নির্দেশ পালনে সচেষ্ট হওয়া
আল্লাহ তাআলার নির্দেশকে ভয় পাওয়া জরুরি। কারণ আল্লাহ তাআলাই নামাজে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা বিনীতভাবে আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হও।’ (সুরা বাকারা: ২৩৮)
আবু কাতাদা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন—‘নিকৃষ্টতম চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কীভাবে চুরি করে? তিনি বললেন, ‘যে রুকু-সেজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না’। (মুসনাদে আহমদ: ৮৮৫)
আরও পড়ুন: ‘নামাজ চুরি’ নিয়ে যা বলেছেন মহানবী (স.)
জীবনের শেষ নামাজ মনে করা
প্রতিটি নামাজই হতে পারে জীবনের শেষ নামাজ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যখন তুমি নামাজে দণ্ডায়মান হবে, তখন এমনভাবে নামাজ আদায় করো, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ।’ (ইবনু মাজাহ, মেশকাত: ৫২২৬)
অতএব নামাজ শুরু করার সময়ই মনে এ কথা গেঁথে ফেলবেন যে এই নামাজই আমার জীবনের শেষ নামাজ। এতে মন স্থির থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কল্যাণলাভের জন্য বিনয়ী থাকা
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা বাকারা: ৪৫) তাই প্রতিটি নামাজি ব্যক্তির এই বিশ্বাস রাখা চাই যে, আল্লাহ আমার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে সে মূলত তার প্রভুর সঙ্গে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে কীভাবে সে কথোপকথন করছে।’ (মুস্তাদরাক হাকিম, সহিহুল জামে: ১৫৩৮)
হাদিসে বলা হচ্ছে- কীভাবে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছ, মনোযোগসহ নাকি মনোযোগ ছাড়া—সেটা যেন মাথায় থাকে। কারণ নামাজ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন।
নামাজের আগে নিজের গুনাহের কথা চিন্তা করা
আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার কথা ভেবে নিজের ভেতর অনুশোচনা নিয়ে আসুন। দণ্ডায়মান অবস্থায় একজন অপরাধীর মতো মস্তক অবনত রেখে দৃষ্টিকে সেজদার স্থানের দিকে নিবদ্ধ রাখুন। রাসুল (স.) দাঁড়ানো অবস্থায় সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখতেন।’ (তাফসিরে তাবারি: ৯/১৯৭)
ওপরের ছয়টি বিষয় অনুসরণ করলে নামাজে মনোযোগ তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। মনে রাখতে হবে, নামাজ কোনো ছোটখাটো ইবাদত নয়, বরং ঈমানের পরে সর্বোত্তম রুকন এবং মর্যাদাপূর্ণ ফরজ। এর ফজিলতও অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজের সময় হলে সুন্দরভাবে অজু করে এবং একাগ্রতার সঙ্গে সুন্দরভাবে রুকু-সেজদার মাধ্যমে নামাজ আদায় করে, তার এ নামাজ আগের সব গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারাজীবনের জন্য।’ (মুসলিম: ২২৮; মেশকাত: ২৮৬)
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে সুন্দরভাবে অজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে (একাগ্রতার সঙ্গে) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে, (অন্য বর্ণনায় এসেছে, যেই নামাজে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।’ (বুখারি: ১৯৩৪; নাসায়ি: ১৫১)

