পবিত্র রমজানে আল্লাহর নৈকট্যলাভের একটি বড় মাধ্যম ইতেকাফ। লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তি, গুনাহ থেকে পরিত্রাণ, বাকি ১১ মাসের ইবাদতের যথার্থ অনুশীলনসহ অসংখ্য বরকতসমৃদ্ধ আমল করা হয় রমজানের শেষ দশকের এই ইবাদতের মাধ্যমে।
ইতেকাফের পরিচয়
ইতেকাফ শব্দের অর্থ স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায়, মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন বা যেকোনো দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম তথা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা ঘরের পবিত্র স্থানে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে।
বিজ্ঞাপন
ইতেকাফের বিধান
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন- وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ অর্থ: ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং (আদেশ দিলাম যে,) তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কর। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুকারী-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর।’ (সুরা বাকারা: ১২৫)
এ আয়াতে আল্লাহ ইতেকাফের গুরুত্বকে বুঝিয়েছেন। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইতেকাফ আল্লাহর দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আল্লাহ প্রথম কাবা শরিফকে তাওয়াফ, ইতেকাফ ও নামাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত, কাবা শরিফে আগে তাওয়াফ আর পরে নামাজ পড়া হয়। তৃতীয়ত ফরজ হোক কিংবা নফল হোক কাবা শরিফের ভেতরে যে কোনো নামাজ আদায় করাই বৈধ।
আরও পড়ুন: ইতেকাফের কিছু জরুরি মাসয়ালা
ইতেকাফের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো- স্বামী-স্ত্রী ইতেকাফে বসলে মেলামেশা করতে পারবে না। এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন- وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا ‘অর্থ: আর যতক্ষণ তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)
রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যে কোনো একজন ইতেকাফ করলে পুরো মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতেকাফ না করে তবে মহল্লার সবার সুন্নত পরিত্যাগের গুনাহ হবে। (দুররুল মুখতার: ২/৪৪০)
বিজ্ঞাপন
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স.) প্রতি বছর ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। অতঃপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর ২০ দিন ইতেকাফ করেন। ( বুখারি: ১৯৯৭)
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণিত হাদিসে আছে— ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। এরপর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ ইতেকাফ করতেন’। (বুখারি: ১/২৭১)
ইতেকাফের উদ্দেশ্য
দুনিয়াদারির ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া এবং বিনয় ও নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করা, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও এই মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম ১০ দিন ও মাঝের ১০ দিন ইতেকাফ করেছি, অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেছেন, তা শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতেকাফ করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে।’ অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গে শেষ দশকে ইতেকাফ করলেন। (মুসলিম)
ইতেকাফের শর্তসমূহ
ইতেকাফের শর্তগুলো হলো- ১. নিয়ত করা ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফ হতে হবে ৩. ইতেকাফকারী রোজাদার হবে ৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-নেফাস হতে পাক হওয়া ৬. পুরুষ লোক জামে মসজিদে ইতেকাফ করবে ৭. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে।
ইতেকাফের প্রকারসমূহ
ইতেকাফ তিন প্রকার—১. সুন্নত ইতেকাফ: রমজানুল মোবারকের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফ সুন্নত। ২১ রমজানের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। উল্লেখ্য, সুন্নত ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে, তা কাজা করা ওয়াজিব।
২. ওয়াজিব ইতেকাফ: মানতের ইতেকাফ ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মানত পূর্ণ করে।’ (সুরা হজ: ২৯)
তাতে কোনো শর্ত থাকুক বা না থাকুক। যেমন- কেউ বললো, ‘আমার এই কাজ সমাধা হলে আমি ইতেকাফ করবো’, এতে যেমন ইতেকাফ ওয়াজিব হবে, ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে- ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইতেকাফ করবো’, এ অবস্থাতেও ইতেকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে।‘ (ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২১৩, দুররুল মুখতার: ২/৪৪১)
৩. নফল ইতেকাফ: এই ইতেকাফ যেকোনো সময় করা যায়। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ। রোজার প্রয়োজন নেই। এমনকি মসজিদে প্রবেশ করার সময় নফল ইতেকাফের নিয়ত করা সুন্নত। এই তিন ধরনের ইতেকাফের ভিন্ন ভিন্ন বিধান আছে।
ইতেকাফের স্থান
পুরুষরা শুধু মসজিদেই ইতেকাফ করতে পারে। ইতেকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদে হারাম, তারপর মসজিদে নববি, তারপর মসজিদে আকসা, এরপর যেকোনো জামে মসজিদ।
জামে মসজিদে ইতেকাফ উত্তম। কারণ জুমার জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। কিন্তু জামে মসজিদে ইতেকাফ করা জরুরি নয়। বরং যেসব শরয়ি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, সে মসজিদে ইতেকাফ করতে পারে। (ফতোয়া শামি: ২/১২৯)
নারীর ইতেকাফ
নারীদের জন্য ইতেকাফ করা মুস্তাহাব। নারীদের ইতেকাফ গৃহকোণে (নামাজের স্থানে) বাঞ্ছনীয়। নারীদের ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি আবশ্যক।
স্বামী স্ত্রীকে ইতেকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪১; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১১)
ইতেকাফ অবস্থায় রাতেও স্ত্রী-সহবাস করা যাবে না। করলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তদ্রূপ স্ত্রীকে চুম্বন, আলিঙ্গন ও উত্তেজনার সাথে স্পর্শ করাও বৈধ নয়। যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে, তাহলে ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। (সুরা বাকারা: ১৮৭; বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮৫, আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৫০; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১৩)
আরও পড়ুন: শবে কদরের সম্ভাবনা ২৭ রমজানেই বেশি
মহিলাদের ঋতুস্রাব অবস্থায় ইতেকাফ করা সহিহ নয়। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১১)
ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইতেকাফ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থেই বাহ্যত আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন- ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি: ২০২০)
ইতেকাফ অবস্থায় কেউ যদি রাতে ঘুমিয়েও থাকে, তবু তাকে ইবাদতকারীদের মধ্যে শামিল করা হবে। তখন শবেকদরের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে ব্যয় করার ফজিলত অর্জন করবেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, في المعتكف هو يعكف الذنوب و يجري له من الحسنات كعامل الحسنات كلها ‘সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, বাবুস সাওম)
ইতেকাফের ফজিলত বর্ণনায় হাদিসে প্রিয়নবী (স.) ঘোষণা দেন-‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব দুই দিগন্তের দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্ব হবে।’ (কানজুল উম্মাল: ২৪০১৯)
ইতেকাফকারী দুই হজ ও দুই ওমরার সাওয়াব পাবেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করবে তার আমল দুই হজ ও দুই ওমরার সমতুল্য’ (শুআবুল ইমান: ৩৬৮১; কানজুল উম্মাল: ২৪০০৬)
ইতেকাফকারী লাইলাতুল কদর লাভ করতে পারবেন। কেননা রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোর যেকোনো একটিতে লাইলাতুল কদর রয়েছে। আর লাইলাতুল কদরের ইবাদত হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। সুতরাং যে ব্যক্তি শেষ দশকে ইতেকাফ করবে তার প্রতিটি মুহূর্ত যেহেতু ইবাদত হিসেবে গণ্য হচ্ছে ফলে সে লাইলাতুল কদর পাবেন, এ রাতের সুমহান মর্যাদা লাভ করতে পারবেন।
ইতেকাফকারীর মসজিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষদের আল্লাহ তাআলা হাশরের ময়দানে আরশের নিচে ছায়া দান করবেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যাদের হৃদয়টা মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে।’ (বুখারি: ৩২১৫)
আরেক হাদিসে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ডেকে বলবেন, ‘আমার প্রতিবেশী লোকেরা কোথায়?’ তখন ফেরেশতারা বলবেন, ‘আপনার প্রতিবেশী আবার কারা?’ আল্লাহ বলবেন, ‘যারা দুনিয়াতে আমার ঘর (মসজিদ) এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রেখেছে এবং মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে।’ (মুসনাদে আহমদ: ১০/২০৩)
তাই মুমিন মুসলমান রোজাদারের উচিত রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফে অংশগ্রহণের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। আল্লাহ তাওফিক দান করুন এবং লাইলাতুল কদর নসিব করুন। আমিন।

