রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ সুন্নত আমল। ২০ রমজান ইফতারের আগে থেকে শুরু করে ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করা হলো মাসনুন ইতেকাফ। নবীজি (স.) অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এই ইতেকাফ করতেন। বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা তা প্রমাণিত। হাদিসে এসেছে- ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। এরপর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ ইতেকাফ করতেন’। (বুখারি: ১/২৭১)
‘এক রমজানে কোনো কারণে তিনি ইতেকাফ করতে পারেননি। তাই পরবর্তী বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফ করেছেন’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৬৮)। নিচে এই মর্যাদাপূর্ণ আমলটির জরুরি কিছু মাসয়ালা তুলে ধরা হলো।
১) বাসা থেকে মসজিদে খাবার আনার কেউ না থাকলে নিজে খাবার আনা জায়েজ
মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় গিয়ে নিজে খাবার নিয়ে আসা জায়েজ। এ কারণে ইতেকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তুত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করা যাবে। (আলবাহরুর রায়েক: ২/৩০৩; আলমুহিতুল বুরহানী: ৩/৩৮০; তাবয়িনুল হাকায়েক: ২/২২৪)
২) পারিশ্রমিক দিয়ে ইতেকাফ করানো যাবে না
রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ। যদি কোনো মসজিদে এক জনও ইতেকাফে বসে তাহলে এলাকাবাসী সুন্নত তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবেন। আর যদি একজনও এতেকাফ না করে তাহলে ওই এলাকার সকলেই গুনাহগার হবেন।
এতেকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই ইতেকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েজ নেই, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এতেকাফ করালে সেই এতেকাফ সহিহ হয় না। অতএব এতে এলাকাবাসী দায়মুক্ত বা জিম্মামুক্ত হবেন না। (হেদায়া; ফাতহুল কাদির: ২/৩০৪; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪২; খুলাসাতুল ফতোয়া: ১/২৬৭; ইলাউস সুনান: ১৬/১৭২-৭৩; রদ্দুল মুখতার ৬/৫৫)
৩) ইতেকাফরত অবস্থায় সালাম দেওয়া-নেওয়া ও কুশলাদির সঠিক বিধান
ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা-যাওয়ার পথে চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবেন। তদ্রুপ এসময় পথ চলতে চলতে কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলা যাবে। তবে, তা হতে হবে পথ চলতে চলতে। এতে ইতেকাফের ক্ষতি হবে না। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইতেকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। তবে এজন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৭২)
বিজ্ঞাপন
তাই কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞেস করার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময় দাঁড়ানোও জায়েজ হবে না। (সহিহ মুসলিম: ২৯৭; মিরকাতুল মাফাতিহ: ৪/৫২৯; ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/১২১)
৪) নাবালেগের ইতেকাফে এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হবে?
নাবালেগ যদি বুঝমান হয়, তার ইতেকাফ সহিহ। তবে ইতেকাফের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমল প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই হওয়া উচিত। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.) তা গুরুত্বসহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা ভালো নয়। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪; আলবাহরুর রায়েক: ২/২৯৯; ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২১১; রদ্দুল মুখতার: ১/৫৭৭)
৫) ইতেকাফের জন্য কেমন মসজিদ জরুরি
পুরুষের ইতেকাফ সহিহ হওয়ার জন্য শরয়ী মসজিদ হওয়া জরুরি। অর্থাৎ যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে অনুষ্ঠিত হয়। জামে মসজিদে ইতেকাফ উত্তম। কারণ জুমার জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। কিন্তু জামে মসজিদে ইতেকাফ করা জরুরি নয়। (ফতোয়া শামি: ২/১২৯)
৬) ইতেকাফ ভেঙে ফেলতে হলে কাজা করার নিয়ম কী?
ইতেকাফের মাঝখানে কেউ অসুস্থতা কিংবা যেকোনো বাধ্যগত কারণে ইতেকাফ ভেঙে ফেলতে হলে তাকে একদিনের ইতিকাফ কাজা করতে হবে। আর তা চাইলে পরবর্তী রমজানেও কাজা করতে পারবেন। এজন্য কোনো একদিন সূর্যাস্তের পর থেকে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত মসজিদে ইতেকাফ করবেন। অবশ্য রমজানের বাইরে ইতেকাফটি কাজা করতে চাইলে দিনের বেলা নফল রোজাও রাখতে হবে। (সূত্র: রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪৪-৪৪৫; আহকামে ইতেকাফ: ৫০)
৭) ইতিকাফ অবস্থায় সাধারণ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে
রমজান মাসের শেষ দশকের ইতেকাফ অবস্থায় সাধারণ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নেই। বের হলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং ওই দিনের ইতিকাফ কাজা করে নেওয়া জরুরি। আর এই ইতেকাফটি নফল ইতেকাফ হিসাবে গণ্য হবে। (মারাকিল ফালাহ: ৩৮৩; ফতোয়া খানিয়া: ১/২২৩; খুলাসাতুল ফতোয়া: ১/২৬৮; ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২১২)
৮) জানাজার নামাজে শরিক হওয়া যাবে?
সুন্নত ইতেকাফকারী জানাজার নামাজের জন্য মসজিদের বাইরে গেলে তার ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ইতেকাফকারীর নিয়ম হলো- অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাবে না এবং (মসজিদের বাইরে) জানাজার নামাজে শরিক হবে না। (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৬৫)
তাই, ইতেকাফকারীর জন্য কোনো কারণে বাইরে অনুষ্ঠিত জানাজায় শরিক হওয়া আবশ্যক হলে তিনি যেতে পারবেন, তবে এ কারণে তার ওই দিনের ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে এবং সুন্নত ইতেকাফও থাকবে না। এক্ষেত্রে তাকে একদিন রোজা অবস্থায় ইতিকাফের কাজা করতে হবে। (আলমুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৮০; ফতোয়া খানিয়া: ১/২২২; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪৫; ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২১২; আলমাবসুত, সারাখসি ১/১১৮)
৯) অসুস্থ ও বৃদ্ধরা রোজা ছাড়া ইতেকাফ করতে পারবেন?
না, এতে সুন্নত ইতেকাফ হবে না। তবে নফল ইতেকাফ হবে। কারণ সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (সুনানে বায়হাকি: ৪/৩১৭; মুসতাদরাকে হাকেম: ২/৮১)
অন্য বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ইতেকাফকারীর জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/৩০০; ফতোয়া খানিয়া: ১/২২১; আহকামুল কুরআন, জাসসাস: ১/২৪৫; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইতেকাফের যাবতীয় আমল সহিহশুদ্ধভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন এবং আল্লাহ সকল ইতেকাফকারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা, অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা ও বিপুল সওয়াব দান করুন। আমিন।

