শবে বরাত ফারসি শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। শবে বরাতে আল্লাহ তাআলা অনুগত বান্দাদের ক্ষমা করে দেন—তাই রাতটি মুক্তির রজনী নামে খ্যাত। আরবি পরিভাষায় একে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়।
এই রাতের ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ তাআলা সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০; সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)
বিজ্ঞাপন
শাবান মাসের ১৫তম রাত বা শবে বরাতের রাতে সলফে সালেহিনরা ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। রাতভর নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, তসবিহ-তাহলিল পাঠ, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি আমলে তাঁরা মশগুল থাকতেন। এছাড়াও কবর জিয়ারত একটি উত্তম আমল।
এই রাতে রাসুলুল্লাহ (স.) চুপিসারে জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এক রাতে রাসুল (স.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন- কি ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? আয়েশা (র.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল— আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৭৩৯)
আরও পড়ুন: শবে বরাতে ৬টি দোয়া করতে ভুলবেন না
সুতরাং শবে বরাতে কবর জেয়ারত করা সুন্নত। তবে তা দলবেঁধে নয়। এ রাতে রাসুল (স.) মদিনার প্রাচীন কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকিতে একাকী গিয়েছিলেন; কোনো সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে যাননি। তাঁর অনুকরণার্থে জরুরি মনে না করে একাকী কবরস্থানে যাওয়া যাবে। তবে এ আমলকে আবশ্যকীয় মনে করা যাবে না। আর মাঝেমধ্যে ছেড়েও দিতে হবে। (ইসলাহি খুতুবাত: ৪/২৫৯-২৬০)
বিজ্ঞাপন
মৃত আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত যেকোনো সময় করা যায়। শুধু শবে বরাতে করতে হবে—এমন নয়। মূলত কবর জিয়ারতে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। নবীজি বলেছেন, ‘তোমরা কবর জিয়ারত করো। কারণ তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (মুসলিম: ৯৭৬)
কিছু মানুষ শবে বরাতে নামাজ, ইস্তেগফারের চেয়ে কবর জেয়ারতের পেছনেই সময় ব্যয় করে। বন্ধুবান্ধব মিলে হৈ-হুল্লোড় করে কবর জিয়ারত করতে যায়। এক কবর থেকে আরেক কবরে, এক মাজার থেকে আরেক মাজারে যাতায়াত করে। এসব ঠিক নয়। বরং এতে তারা শবে বরাতের প্রকৃত ফজিলত থেকে বঞ্চিত হয়।
আর পড়ুন: শবে বরাতে ৩টি কাজ ভুলেও করবেন না
শবে বরাতে মসজিদে ফরজ নামাজ শেষ করে ঘরে এসে একাকী দীর্ঘ সেজদায় নামাজ পড়ার কথা হাদিসে রয়েছে। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন—‘একবার রাসুলুল্লাহ (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসুল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। তখন নবী (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)
উল্লেখিত হাদিস থেকে এ রাতের মাহাত্ম্য যেমন জানা যায়, একইভাবে এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তাও বোঝা যায়। এই রাতে প্রিয়নবী (স.) এত লম্বা সেজদায় ছিলেন যে আয়েশা (রা.) ভাবলেন যে নবীজি মারাই গেছেন। সুতরাং উম্মত হিসেবে আমরাও এই রাতে দীর্ঘ সেজদার সঙ্গে নফল নামাজ পড়ব ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সুন্নতের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

