দাওয়াত মানে আহ্বান। ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে ডাকা হলো দাওয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন- اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ ‘তোমরা ডাকো তোমাদের রবের পথে, হেকমত এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা নাহল: ১২৫)। তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। আল্লাহ বলেন- فَاِنَّمَا عَلَیۡکَ الۡبَلٰغُ وَ عَلَیۡنَا الۡحِسَابُ ‘আপনার দায়িত্ব তো পৌঁছে দেওয়া, আর আমার দায়িত্ব হিসাব নেওয়া।’ (সুরা রাদ: ৪০) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি কথা হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১; তিরমিজি: ২৬৬৯)
হজরত আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসুলই মৌলিকভাবে অভিন্ন দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً ۟ فَبَعَثَ اللّٰهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۪ وَ اَنۡزَلَ مَعَهُمُ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ فِیۡمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ ‘সব মানুষ একই দ্বীনের অনুসারী ছিল। তারপর আল্লাহ নবী পাঠালেন। যারা সুসংবাদ শোনাত এবং ভীতি প্রদর্শন করত। আর তাঁদের সঙ্গে সত্যসংবলিত কিতাব অবতীর্ণ করলেন। যাতে তাঁরা মানুষের মধ্যকার মতভেদপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসা করে দেন।’ (সুরা বাকারা: ২১৩)
বিজ্ঞাপন
নবী-রাসুলগণের দাওয়াতের বিষয়বস্তু মৌলিকভাবে দুটি। ১ ঈমান, অন্যভাবে বললে আকিদা-বিশ্বাস। ২. আমল বা শরিয়তের পালনীয় বিধি-বিধান। নবী-রাসুল (আ.)-এর দাওয়াতের বিষয়গুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
১. আকিদা-বিশ্বাস
যুগে যুগে নবীগণ যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিশুদ্ধ আকিদা ও বিশ্বাস। কেননা আকিদার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করতে সক্ষম হয়। সব নবী মৌলিকভাবে যে তিনটি বিষয়ের ওপর ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন, তা হলো—১. আল্লাহর একত্ববাদ ২. নবুয়ত ও রিসালাত ৩. পরকালের পুরস্কার ও শাস্তি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ‘আমি আপনার আগে যে রাসুলই প্রেরণ করেছি, তাঁর প্রতি অবশ্যই এ ওহি পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অতএব, আমার ইবাদত করো। (সুরা আম্বিয়া: ২৫)
আরও পড়ুন: ঈমান মজবুত করার উপায়
২. ইবাদত
আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও দ্বীনের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের পর মুমিনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো- আল্লাহর ইবাদত করা। পৃথিবীর সব নবী-রাসুল মানুষকে আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কেননা এটাই মানব সৃষ্টির প্রধান লক্ষ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন- وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ আমি জ্বিন ও মানুষকে এজন্যই সৃষ্টি করেছি, যেন তারা আমার ইবাদত করে। (সুরা জারিয়াত: ৫৬)
বিজ্ঞাপন
৩. মুআমালাত বা লেনদেন
ইবাদতের পর মুআমালাত বা পারস্পরিক লেনদেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এর সঙ্গে মানুষের অধিকার জড়িত। নবী-রাসুলগণ মানুষকে লেনদেনে সৎ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শোআইব (আ.) তাঁর জাতিকে বলেন- وَ یٰقَوۡمِ اَوۡفُوا الۡمِکۡیَالَ وَ الۡمِیۡزَانَ بِالۡقِسۡطِ وَ لَا تَبۡخَسُوا النَّاسَ اَشۡیَآءَهُمۡ وَ لَا تَعۡثَوۡا فِی الۡاَرۡضِ مُفۡسِدِیۡنَ ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিমাপ ও ওজন করো, মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিয়ো না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (সুরা হুদ: ৮৫)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই; যার প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই তার দীন নেই।’ (মুসনাদে আহমদ: ১২৩৮৩)
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া ২২টি মর্যাদাপূর্ণ সুন্নত
৪. মুআশারাত বা সামাজিক আচার-অধিকার
একটি আদর্শ ও সুন্দর সমাজ গঠনে সামাজিক সচ্চরিত্র ও মানবিক আচরণ আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ‘হে মুমিনরা, তোমরা বেশির ভাগ অনুমান থেকে দূরে থাকো; কেননা অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং পরস্পরের অনুপস্থিতিতে নিন্দা করো না।’ (সুরা হুজরাত: ১২) দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এক শ্রেণির মুসলমান শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনার পর নামাজ পড়া আর সত্য বলাই যথেষ্ট মনে করেন।
৫. সিয়াসাত বা রাষ্ট্রব্যবস্থা
রাষ্ট্রীয় কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ হলে কোনো সমাজের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রটিও নবীগণের দাওয়াতের আওতাভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন- لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِالۡبَیِّنٰتِ وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসুলদের প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সুরা হাদিদ: ২৫)। আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করছেন যে- وَ اُمِرۡتُ لِاَعۡدِلَ بَیۡنَکُمۡ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন,...আমাকে আদেশ করা হয়েছে তোমাদের মাঝে ন্যায় বিচার করতে।’ (সুরা শুরা: ১৫) আল্লাহ আরও বলেছেন- وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُهَیۡمِنًا عَلَیۡهِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَهُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ ‘আর আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব নাজিল করেছি তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী ও সেগুলোর (বিষয়বস্তুর) সংরক্ষকরূপে। অতএব, আপনি তাদের মধ্যে, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুসারে ফায়সালা করুন।’ (সুরা মায়েদা: ৪৮)
আরও পড়ুন: নবীজির অনুসরণ কেমন হওয়া উচিত
৬. আখলাক বা উত্তম চরিত্র
সব নবী-রাসুল ছিলেন উত্তম আদর্শের অধিকারী। তাঁরা মানুষকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ ‘যেমন আমি তোমাদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তোমাদের পবিত্র করেন, তোমাদের কিতাব ও গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’ (সুরা বাকারা: ১৫১)। নববী দাওয়াতে উত্তম আখলাকের পরিধি অনেক বিস্তৃত। নিছক সৌজন্যের ব্যবহার আর কৃত্রিম ভদ্রতাকে নববী দাওয়াতে ‘উত্তম আখলাক’ বলে না। এখানে উত্তম আখলাক শুরু হয় পরিচ্ছন্ন অন্তর থেকে। সমাপ্ত হয় বহিরাঙ্গের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, ‘আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা প্রদানের জন্য।' (মুয়াত্তা মালেক: ২৬৩৩, ১৮৮৫, ৬৫১; মুসনাদে বাযযার: ৮৯৪৯)
মৌলিকভাবে এই ছয়টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে মানুষের ইহকালীন সাফল্য ও পরকালীন মুক্তি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবী-রাসুল (আ.)-এর শিক্ষা অনুসরণ ও বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন। আমিন।