নতুন বছর এলে একজন মুমিনের উচিত- ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করা এবং আগামীর জন্য পরিকল্পনা করা। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকের উচিত আগামীর জন্য সে কী করেছে তা খতিয়ে দেখা..।’ (সুরা হাশর: ১৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
বিজ্ঞাপন
মুসলমানের কাছে প্রতিটি দিন মূল্যবান। প্রত্যেকটি সকাল মানেই নতুন আরেকটি সুযোগ। সেই সুযোগটি হলো নিজের ঈমান-আমলকে সমৃদ্ধ করার। সাহাবায়ে কেরাম ও মুসলিম মনীষীরা পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, (আখেরাতে) তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে নিজেরা নিজেদের হিসাব করো। একইভাবে আমল পরিমাপের আগে নিজেরা একটু মেপে দেখো। কেননা আগামীদিনের হিসাব-নিকাশের আগে আজ নিজের হিসাব মিলিয়ে নেওয়া সহজ। (ইগাসাতুল লাহফান, পৃষ্ঠা-৯৪)
আরও পড়ুন: পুলিশ কি পারবে আতশবাজি পটকা ফানুস বন্ধ করতে?
নতুন বছর বা নওরোজকে পটকা ফুটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে, হৈ-হুলোড় করে উদযাপন করতে হবে—এমন কিছু ইসলামে নেই। বরং এসব অমুসলিমদের সংস্কৃতি। তাই মুসলমানরা এসব করতে পারে না। কেউ এসব কাজে যোগ দিলে হাদিসের ভাষ্যমতে তার পরিণতি ভালো হবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবুদাউদ, মেশকাত: ৪৩৪৭)
এমনকি ভালো কাজের জন্যও বিকট শব্দ করা ইসলামে অপছন্দনীয়। এতে রোগী, শিশু-বৃদ্ধদের কষ্ট হয়। ওমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে নববিতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করতেন। এতে হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হত। তাই তিনি ওমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে তিনি তাকে শাস্তি দেন। (আখবারু মদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ: ১/১৫)
বিজ্ঞাপন
সুতরাং উৎসবের নামে যেকোনো অনর্থক কাজ থেকে মুসলিমদের বিরত থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮)
দোয়া করতে হবে যেন ভবিষ্যতের দিনগুলো সুন্দর ও কল্যাণকর হয়। আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম বলেন- রাসুল (স.)-এর সাহাবিরা নতুন মাসের শুরুতে এই দোয়া পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন- اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ، وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلَامَةِ، وَالْإِسْلَامِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন।’ (আল-মুজাম আল-আওসাত: ০৬/২২১)
আরও পড়ুন: ইসলামে নতুন বছরের মূল্যায়ন
দোয়াটি এভাবেও পড়া যায়— اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ ، وَالإِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ ، وَالإِسْلامِ ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমান।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। (মু’জামুস সাহাবাহ: ০৩/৫৪৩; আল-ইসাবাহ: ০৬/৪০৭-৪০৮)
এ বিষয়ে আরেকটি সুন্দর দোয়া হলো—اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي وَزِدْنِي عِلْمًا الْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ وَأَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ حَالِ أَهْلِ النَّارِ ‘আল্লাহুম্মানফা’নি বিমা আল্লামতানি, ওয়া আল্লিমনি মা ইয়ানফাউনি ওয়া জিদনি ইলমা, আলহামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হা-ল, ওয়া আউজুবিল্লাহি মিন হা-লি আহলিন না-র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাকে তুমি যা শিখিয়েছ তা দিয়ে আমাকে উপকৃত কর, আমার জন্য যা উপকারী হবে তা আমাকে শিখিয়ে দাও এবং আমার ইলম (জ্ঞান) বাড়িয়ে দাও। সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা এবং আমি জাহান্নামিদের অবস্থা থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (স.) এই দোয়া করতেন।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৯)
চন্দ্রবছরের ক্ষেত্রে যে দোয়া পড়া সুন্নত—اللهم أهله علينا بالأمن والإيمان، والسلامة والإسلام، ربنا وربك الله ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত করো নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’ সাহাবি তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (স.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন। (তাবরানি: ১২/৩৫৬; মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১০/৩৫৬; সুনান আদ-দারিমি: ১৭২৫)
ইসলামে নতুন বছরে অনেক করণীয় রয়েছে। তন্মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার অন্যতম। বছরের প্রথম দিনে ব্যক্তি পুরনো বছরের আত্মপর্যালোচনা করবে। নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজাবে। ঈমান ও আমলের সমৃদ্ধির জন্য কর্মতৎপর হয়ে ওঠবে। এই কাজটি সহজ করার জন্য সবার উচিত- কোরআন-হাদিস চর্চা ও সিরাত-সাহিত্য অধ্যয়নের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া।
বরেণ্য আরবি সাহিত্যিক শায়খ আলী তানতাবির বলেন, ‘মুসাফির পথের একটি মনজিল অতিক্রম করার পর একটু থামে। পেছন ফিরে দেখে, কতটুকু পথ সে অতিক্রম করেছে আর কতটুকু বাকি। ব্যবসায়ী বছরশেষে হিসাব করে এক বছরে কী পরিমাণ লাভ হয়েছে কিংবা কোনো লোকসান হয়েছে কি না! নতুন বছর একটি নতুন স্টেশন। জীবনের পথ চলতে গিয়ে আমরা এখানে একটু থামি। বুঝতে পারি, জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে গেছে! এখানে এসে আমরাও কি একটু হিসাব মেলাব না?’
অতএব চলুন আমরা নিজেকে নিয়ে একটু ভাবি, কায়মনোবাক্যে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবি প্রার্থনা করি। তাওবা-ইস্তেগফারে নতুন বর্ষকে কাজে লাগাই আর স্মরণ করি নবী (স.)-এর বাণী—كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ، وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُورِ ‘দুনিয়াতে তুমি পরদেশি কিংবা পথিকের মতো থাক এবং নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর। (অর্থাৎ তোমাকে যে নিশ্চিত কবরে যেতে হবে, সেটা মনে রাখ।) (জামে তিরমিজি: ২৩৩৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সকল অপসংস্কৃতি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর দিনগুলো যেন কল্যাণময় হয় সেদিকে মনোযোগী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

