মুমিনের জীবনে আনন্দ-বেদনার ভিত্তি হলো পরকাল। যদি মুমিন পরকালের পাথেয় যথাযথভাবে অর্জন করতে পারে, তবেই সে সফল। আল্লাহ বলেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে; সে-ই সফল। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ্য ছাড়া কিছু না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)
সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ মিলিয়ে শেষ হয় একটি বছর। শুরু হয় নতুন এক আয়োজন, নতুন এক অধ্যায়। জীবনকে ঢেলে সাজানের নতুন এক সুযোগ। এটি আল্লাহরই অনুগ্রহ। কেননা তিনিই সময়ের মালিক। তিনিই বিগত দিনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দিলেন। এজন্য প্রথমেই মহান স্রষ্টার কৃতজ্ঞতা আদায় করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই বাড়িয়ে দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)
বিজ্ঞাপন
নতুন বছর বরণের আয়োজনটা ঘটে করে পালন করেন অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণে। তবে একজন মুমিনের উচিত- ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করা এবং আগামীর জন্য পরিকল্পনা করা। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকের উচিত আগামীর জন্য সে কী করেছে তা খতিয়ে দেখা..।’ (সুরা হাশর: ১৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
নতুন বছর বা নওরোজ উদযাপন বলতে ইসলামে কিছু নেই। পটকা ফোটানো, হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদি অমুসলিমদের সংস্কৃতি। ইসলামে এসবের অনুমোদন নেই। বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন নবীজি (স.)। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবু দাউদ, মেশকাত: ৪৩৪৭)
মুসলমানের কাছে প্রতিটি দিন মূল্যবান। প্রত্যেকটি সকাল মানেই নতুন আরেকটি সুযোগ। সেই সুযোগটি হলো নিজের ঈমান-আমলকে সমৃদ্ধ করার। রাসুল (স.) বলেন, ‘জান্নাতের অধিবাসীগণ দুনিয়ার কোনো কিছুর জন্য আফসোস করবে না। শুধু সেই সময়গুলোর জন্য আফসোস করবে, যা আল্লাহর জিকির ছাড়া অতিবাহিত হয়েছে।’ (তাবারানি: ২০/৯৩; তারগিব: ২/৩৭৫)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, (আখেরাতে) তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে নিজেরা নিজেদের হিসাব করো। একইভাবে আমল পরিমাপের আগে নিজেরা একটু মেপে দেখো। কেননা আগামী দিনের হিসাব-নিকাশের আগে আজ নিজের হিসাব মিলিয়ে নেওয়া সহজ। (ইগাসাতুল লাহফান, পৃষ্ঠা-৯৪)
আমরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছি। একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার অর্থ হলো- জীবন থেকে একটি বছর শেষ হয়ে গেল। তাই মুমিনের দায়িত্ব হবে—বিগত গুনাহ থেকে হুঁশিয়ার হওয়া এবং ভবিষ্যতকে পরকালের কল্যাণে বিনিয়োগ করা। আল্লামা ইবনু কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘সময় নষ্ট করা মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয়াবহ। কেননা সময়ের অপচয় তোমাকে আল্লাহ, পরকাল ও জান্নাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আর মৃত্যু তোমাকে শুধু পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো সেই কাজে লিপ্ত থাকা, যা অধিক উত্তম ও পরকালে বেশি উপকারী। ’ (মাওয়ারিদুজ জামআন লি-দুরুসিজ জামান: ৪/৪৬৯)
একজন মুমিন নতুন বছরকে আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে বিশেষ কিছু আমলের প্র্যাকটিস করবেন। যেমন—সব অবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ও সবরের ট্রেনিং। সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা ও দীনে অটল অবিচল থাকার প্রশিক্ষণ। কোরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, নফল রোজা, দান-সদকাসহ নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করা। মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার শপথ। সমাজে ব্যাপকভাবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ—এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করা। মুমিন মুমিনের প্রতি সহায়ক ও ভাইয়ের মতো আচরণ করা। আল্লাহওয়ালাদের পাশে থাকা, প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী কোরআন-হাদিস ও সিরাত পাঠ করা। এসব আমল মুমিনের জন্য হতে পারে নতুন বছরের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
তবে অতীতের সকল গ্লানি ও কল্যাণকর আগামীর প্রথম পদক্ষেপ হবে তাওবা। আন্তরিক তাওবার মাধ্যমেই অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, যা ভবিষ্যতকে মঙ্গলময় করতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিন্তু যারা তাওবা করে, নিজেদের সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশে তাদের দীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনদের আল্লাহ অবশ্যই মহা পুরস্কার দেবেন।’ (সুরা নিসা: ১৪৬)
মূল কথা হচ্ছে, সময়কে এখন থেকে, এই মুহূর্ত থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের জন্য অপেক্ষা করো না। আর যখন তোমার সকাল হয় তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা কোরো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে আর তোমার মৃত্যুর জন্য জীবনকে কাজে লাগাও। (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)
‘এসব মাস, বছর, রাত ও দিন—সব কিছু সময়ের সীমা নির্ধারণ মাত্র, যা বান্দাকে ইবাদতের সময় নির্ধারণ করে দেয়। যা খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। ... মুমিনের জীবনের যে সময়টি কেটে যায় নিশ্চয়ই সে সময়ে আল্লাহ কর্তৃক কোনো দায়িত্ব তার ওপর ছিল এবং তার আনুগত্যে তা অতিবাহিত করা আবশ্যক ছিল। মুমিনের জীবন এসব বিষয়েই আবর্তিত হবে। সময়মতো দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে সে তার ইবাদত করার পর আত্মতৃপ্তিতে ভোগে না। বরং তার ভাবনার পুরোটাতে মহান আল্লাহ বিরাজ করে। সে ভয় পায়, না জানি কখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যান, না জানি কখন একটু অমনোযোগিতার কারণে তার সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে যায়।’ (তাফসিরে ইবনে রজব, ১/৬১১)
অতএব জীবন ও জীবনের সময় সম্পর্কে মুমিন কখনো উদাসীন থাকতে পারে না। সময়ের ব্যাপারে সে আল্লাহর জবাবদিহিতাকে ভয় পায়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? এবং পূর্বে তাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের মতো যেন তারা না হয়, বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তাদের অধিকাংশ সত্যত্যাগী।’ (সুরা হাদিদ: ১৬)
এছাড়াও আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে যেন আগামীর দিনগুলো সুন্দর ও কল্যাণকর হয়। আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম বলেন- আল্লাহর রাসুল (স.)-এর সাহাবিরা নতুন মাসের শুরুতে এই দোয়া পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। দোয়াটি হলো-
اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ، وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلَامَةِ، وَالْإِسْلَامِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন।’ (আল-মুজাম আল-আওসাত: ০৬/২২১)
দোয়াটি এভাবেও পড়া যায়— اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ ، وَالإِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ ، وَالإِسْلامِ ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমান।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। (মু’জামুস সাহাবাহ: ০৩/৫৪৩; আল-ইসাবাহ: ০৬/৪০৭-৪০৮)
আগামীর দিনগুলো কল্যাণকর হওয়ার জন্য আরেকটি সুন্দর দোয়া হলো—اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي وَزِدْنِي عِلْمًا الْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ وَأَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ حَالِ أَهْلِ النَّارِ ‘আল্লাহুম্মানফা’নি বিমা আল্লামতানি, ওয়া আল্লিমনি মা ইয়ানফাউনি ওয়া জিদনি ইলমা, আলহামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হা-ল, ওয়া আউজুবিল্লাহি মিন হা-লি আহলিন না-র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাকে তুমি যা শিখিয়েছ তা দিয়ে আমাকে উপকৃত কর, আমার জন্য যা উপকারী হবে তা আমাকে শিখিয়ে দাও এবং আমার ইলম (জ্ঞান) বাড়িয়ে দাও। সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা এবং আমি জাহান্নামিদের অবস্থা থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (স.) এই দোয়া করতেন।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৯)
চন্দ্রবছরের ক্ষেত্রে এই দোয়াটি পড়া সুন্নত—اللهم أهله علينا بالأمن والإيمان، والسلامة والإسلام، ربنا وربك الله ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত করো নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’ সাহাবি তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (স.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন। (তাবরানি: ১২/৩৫৬; মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১০/৩৫৬; সুনান আদ-দারিমি: ১৭২৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদের একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী দান করুন। আমিন।

