ইসলামের জন্য রাসুলুল্লাহ (স.)-কে ছোট-বড় অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় ২৭টি বড় ধরনের যুদ্ধ (গাজওয়া), ৬০টি ছোটখাটো দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ (সারিয়া) সরাসরি পরিচালনা করেছেন। (ইসলামী বিশ্বকোষ) মুফতি শাফি (রহ.) লিখেছেন, বড় যুদ্ধ গাজওয়া ২৩টি এবং ছোটখাটো যুদ্ধ (সারিয়া) ৪৩টি। (মুফতি শাফি, সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৫)
মহানবী (স.)-এর সিরাতে দেখা যায়, নবী (স.) ও তাঁর সাহাবিরা বারবার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার আগুনে পুড়েছেন। ফলে ইহুদিদের সঙ্গেই চারবার যুদ্ধ করতে হয়েছে নবীজিকে। এসব যুদ্ধে ঈমানের অদম্য শক্তিতে সাহাবিগণ বিজয় অর্জন করেন। নিচে ইহুদিদের বিরুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুদ্ধগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
বিজ্ঞাপন
গাজওয়া বনু কায়নুকা
মহানবী (স.)-এর হিজরতের পর মদিনার বনু কায়নুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাজিরের সঙ্গে নবীজি শান্তি চুক্তি করেন। কিন্তু সর্বপ্রথম বনু কায়নুকা চুক্তি ভঙ্গ করে। নবীজি (স.) তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দেন। এ যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, একদিন রাসুল (স.) ইহুদিদের স্বর্ণের বাজারে গিয়ে তাদের উদ্দেশে হৃদয়গ্রাহী এক বয়ান পেশ করেন। মক্কার কাফেরদের পরিণতি উল্লেখ করে তাদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে নিজেদের বীরত্বের কথা জাহির করতে থাকে। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা আলে ইমরানের ১২ ও ১৩নং আয়াত নাজিল করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/১৭, সিরাতুল মুস্তফা: ২/১৪৭)
আরও পড়ুন: কোরআনের বর্ণনায় ইহুদি সম্প্রদায়
আরেক পটভূমি অনুযায়ী ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, জনৈক আরব মহিলা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বনু কায়নুকা গোত্রের বাজারে যায়। সেখানে এক স্বর্ণকারের সঙ্গে হিজাব খোলা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা হয়। ইহুদি স্বর্ণকারের ধূর্ততায় মহিলার কাপড় খুলে যাওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী মহিলার চিৎকারে ছুটে আসে মুসলমান। বেধে যায় উভয় পক্ষের যুদ্ধ। (সিরাত ইবনে হিশাম: ১/১৭২)
এক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত আবু লুবাবা ইবনে আব্দুল মুনজির আনসারিকে নিযুক্ত করে বনু কায়নুকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। ওরা কেল্লার ফটক বন্ধ করে দিলে নবীজি তাদের ১৫ দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা নবীজির কাছে নতি স্বীকার করে। কিন্তু মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলের অনুরোধে তাদের হত্যা ছাড়াই দেশ থেকে বের করে দেন। ২য় হিজরির ১৫ শাওয়ালে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের তুলনা তাদের পূর্বে যারা নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করেছে তাদের মতো এবং তাদের জন্য ও রয়েছে যন্ত্রণায়ক শাস্তি। (সুরা হাশর: ১৫)
বিজ্ঞাপন
গাজওয়া বনু নাজির
বদর যুদ্ধের পর এবং ওহুদ যুদ্ধের আগে চতুর্থ হিজরিতে গাজওয়া বনু নাজির সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ হয় ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা ও মহানবী (স.)-কে হত্যার পরিকল্পনার জন্য। আমর ইবনে উমাইয়া দামেরি (রা.) রাসুল (স.)-এর সঙ্গে বনু আমেরের চুক্তির কথা জানতেন না। তাই তিনি বিরে মাউনার প্রতিশোধবশত বনু আমের গোত্রের দুজনকে হত্যা করেন। তখন রাসুল (স.) চুক্তিবদ্ধ বনু নাজিরের কাছে গেলেন মুক্তিপনের চাঁদা আদায়ের জন্য। তারা প্রকাশ্য চাঁদা আদায়ের সম্মতি জানিয়ে গোপনে মহানবীকে হত্যার পরিকল্পনা করল। আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কাব ছাদের ওপর থেকে পাথর ফেলে নবীজিকে হত্যার জন্য উপরে উঠল।
আরও পড়ুন: কতজন নবীকে হত্যা করেছিল বনি ইসরাইল
তৎক্ষণাৎ ওহির মাধ্যমে বিষয়টা অবগত হয়ে নবীজি (স.) মদিনায় আসেন। পরে আবু বকর (রা.), ওমর (রা.) ও অন্য সাহাবিরা মদিনায় ফিরে এসে তাদের হত্যার পরিকল্পনার কথা শোনেন। তখন আল্লাহর রাসুল (স.) তাদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদিনায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রেখে বনু নাজিরের দুর্গ অবরোধ করেন। মুনাফিকদের আস্ফাালনে নতুন আলোচনায় বসার সময় তারা আবারো নবীজিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বারংবার তাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে রাসুলুল্লাহ (স.) হামলার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ ১৫ দিন পর্যন্ত তাদের ঘিরে রাখেন। তাদের বাগানের বৃক্ষগুলো কেটে ফেলা এবং জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশেষে তারা ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিরাপত্তার আবেদন করে। তাদের ১০ দিন অবকাশ দেওয়া হয় মদিনা খালি করে দেওয়ার জন্য। যুদ্ধ সরঞ্জাম ছাড়া সবকিছু নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে লোভী ইহুদিরা ঘরের দরজা, চৌকাট পর্যন্ত উটের পিঠে বহন করে খায়বার এবং সিরিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা যাওয়ার সময় গানবাদ্য বাজিয়ে ধুমধাম ও অহংকারের সঙ্গে চলে যায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/১৪৯, সিরাত ইবনে হিশাম: ১/২০২)
গাজওয়া বনু কুরাইজা
এই যুদ্ধ পঞ্চম হিজরিতে সংঘটিত হয়। বনু করাইজার সঙ্গে রাসুলুল্লাহর (স.) আগে থেকে চুক্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু যখন মক্কার কাফেররা ১০ হাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মদিনার আক্রমণ করল তখন তারা চুক্তি ভঙ্গ করে কাফেরদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে কাফেররা হেরে গেলে ওরা ভয়ে মজবুত দুর্গে আত্মগোপন করে। খন্দক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পরপর নবীজির কাছে জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, আপনি অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলেছেন অথচ বনু কুরাইজা এখনো গৃহে ফিরে যায়নি। মহান আল্লাহ আপনাকে সেদিকে যাওয়ার দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি নিজেও সেদিকে যাচ্ছি। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সাহাবিদের নিয়ে তিনি আবারো রওনা হলেন। এরপর রাসুলুল্লাহ (স.) আলী (রা.)-কে ইসলামের ঝান্ডাসহ সেখানে পৌঁছে তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। ২৫ দিন অবরোধ শেষে অসুস্থ সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.)-কে ওদের বিচারের জন্য আহ্বান করা হলো। সাদ (রা.) বললেন, আমি তাদের ব্যাপারে ফায়সালা করছি যে, তাদের মধ্যকার যুদ্ধে সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হোক, আর নারী ও শিশুদের বন্দি করে দাস-দাসীতে পরিণত করা হোক, আর তাদের ধনসম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হোক, রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, নিঃসন্দেহে তুমি আল্লাহর নির্দেশমতো ফয়সালা করেছ। এরপর তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। (সিরাতুল মুস্তফা: ২/২৮০, সিরাত ইবনে হিশাম: ১/২২০)
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে হাদিসে কী আছে
গাজওয়া খায়বার
খায়বরের যুদ্ধ সপ্তম হিজরিতে সংঘটিত হয়। মদিনার বিতাড়িত বনু নাজির যখন খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করল, তখন খায়বর ইহুদিদের মজবুত নেটওয়ার্ক ও সেন্টারে পরিণত হলো। তারা আরবের নানা লোককে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করত এবং মদিনা আক্রমণ করার জন্য জনবল তৈরি করত। মহান আল্লাহর নির্দেশে রাসুলুল্লাহ (স.) ১৪শ পদাতিক ও দুইশত অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তাদের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তুমুল যুদ্ধের পর আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের বিজয় দান করেন। ইহুদিদের সব মজবুত দুর্গ মুসলমানদের হাতে চলে আসে। এ যুদ্ধে আলী (রা.)-এর ভূমিকা ছিল অন্যতম। খায়বরের প্রধান গেট একাই উপড়ে ফেলেন। অথচ ৭০ জন লোক তা ওঠাতে সক্ষম ছিল না। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি এ দরজাটি হাতের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। (সিরাতুল মুস্তফা: ২/৩৫৬; সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া: ৮৭)
মূলত এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর কৃত ওয়াদা বাস্তবায়ন করেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে ওয়াদা করেছেন প্রচুর গণিমতের, যা তোমরা গ্রহণ করবে। এটা আমার নেয়ামত যা আল্লাহ তোমাদের শিগগিরই দেবেন।’ (সুরা ফাতহ: ২০)
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিন কি নবীজির ভবিষ্যদ্বাণীর দিকেই এগোচ্ছে?
উল্লেখ্য, ইহুদিদের রক্তে মিশে আছে গাদ্দারির ইতিহাস। নবীজির ইন্তেকালের পরেও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতর ইতিহাস দীর্ঘ। হজরত আবু বকর (রা.)-এর বাস্তবোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ, ওমর (রা.)। তাঁর অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব তাদের সব ধরনের শয়তানি অপচেষ্টায় বিরত থাকতে বাধ্য করে। কিন্তু হজরত ওসমান (রা.)-এর দয়া ও সহিষ্ণুতার সুযোগে তত্পর ইহুদিরা মুনাফিকদের সঙ্গে হাত মেলায়। এ সময় আবদুল্লাহ বিন সাবা নামক ইয়েমেনের অন্তর্গত সান’আর একজন ইহুদি মুসলমান হওয়ার দাবি করে এবং আগে থেকে মুসলিম সমাজে অবস্থানরত মুনাফিকদের গোপন তত্পরতায় যোগ দেয়। অল্প দিনের মধ্যেই সে তার অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা, নেতৃত্ব গুণ, উদ্ভাবনী শক্তি ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব মুনাফিককে ছাড়িয়ে যায়। (আল বিদায়া ওয়াননিহায়া, ইবনে কাসির: ৭/১৬৭-১৭০)
এরপর ইহুদিরা কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও নাসারাদের সঙ্গে এক হয়ে মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিমূলেই আঘাত হানতে প্রয়াস পায়। তারা হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাঁকে শহীদ করে। পরবর্তী সময়ে হজরত আলী (রা.)-এর ছত্রচ্ছায়ায় এসে কূটচাল আরম্ভ করে। এর ফলে হজরত আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে মুসলিম উম্মাহর রক্ত প্রবাহিত করে। পরবর্তী সময় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে শহীদ করে। তাঁর পুত্র হাসান (রা.)-কেও একই ষড়যন্ত্রের জালে শহীদ করে। পরবর্তী সময় কারবালায় হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতও একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য-ফেরকাবাজির যে সূত্রপাত অভিশপ্ত ওই ইহুদি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুরু হয়, আজ পর্যন্ত ওই ফেতনার দ্বার বন্ধ হয়নি।
সুতরাং এ জাতিকে যারা এখনো বিশ্বাস করবে, তাদের সঙ্গে যারা মিথ্যাচার করবে, তাদের প্রতি যারা অনুকম্পা দেখাবে তারাও এই উম্মাহর বিশ্বাসঘাতক। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইহুদিদের ইতিহাস থেকে সতর্ক হওয়ার এবং সিরাতে রাসুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

