সব প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগ নেই। কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু সামনে উপস্থিত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন মাটিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।’ (সুরা লোকমান: ৩৪) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের পাকড়াও করবেই। এমনকি যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গেও অবস্থান করো।’ (সুরা নিসা: ৭৮)
মুমিন ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয় মৃত্যুর ব্যাপারে বেখবর থাকা। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, মা-বাবা ও সন্তান-সন্ততির মায়া মহব্বত ইত্যাদি যেন মৃত্যুর ব্যাপারে মুমিনকে উদাসীন না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়াবি আকর্ষণই মূলত মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষকে বেখবর করে রাখে। সেজন্যই আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘বেশি থেকে বেশি (দুনিয়া) কামানোর লোভ তোমাদের গাফেল করে রাখে।’ (সুরা তাকাসুর: ১)
বিজ্ঞাপন
অথচ স্মরণ রাখা উচিত ছিল যে দুদিন পরেই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে মাটির গর্তে। যেখানে নিচে, উপরে, ডানে বামে থাকবে শুধুই মাটি। অথবা কোনো দুর্ঘটনায় এমন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে পারে যে কবর দেওয়ার জন্যও শরীরের কোনো টুকরো অবশিষ্ট থাকবে না অথবা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও কি তার রেহাই মিলবে? কখনও না। আলমে বরজখে রুহের সাথে শরীর যুক্ত হবে। বদকারদের শাস্তি হবে, এরপর হাশরের দিনের অপমানজনক শাস্তি পাওয়ার পরে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে জাহান্নামিদের। জাহান্নামের আগুনের এমন শক্তি থাকবে যা জাহান্নামিদের শরীর পোড়ানোর পাশাপাশি তাদের হৃৎপিণ্ডও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটি আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা তাদের হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলবে।’ (সুরা হুমাজা: ৬-৭)
আরও পড়ুন: কবর বা আলমে বরজখ কেমন জগত?
এই শাস্তি থেকে কতদিনে মুক্তি মিলবে, তার নির্দিষ্ট সময় বর্ণিত হয়নি। পাপী মুমিনরা একদিন না একদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেলেও অনেকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটা তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি।’ (সুরা তাওবা: ৬৮)
সুতরাং মৃত্যুকে ভয় করতে হবে। এতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা সহজ হয়। ফলে ইহকাল-পরকাল সুন্দর হবে। মৃত্যুকে ভুলে থাকলে ভালো কাজের ইচ্ছা জাগবে না। আল্লাহর অনুগত হওয়ার পরিবর্তে মুক্ত মন নিয়ে খেয়ালখুশিমতো জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। তখন পুনরায় দুনিয়ায় ফেরার সুযোগ থাকবে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এরপর যখন তাদের কারো মৃত্যু আসবে, তখন সে বলবে, হে আমার রব, আমাকে আবার ফেরত পাঠান। যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি যা আমি করিনি। কক্ষনো না, এটা তো তার একটা কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে বরজখ থাকবে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৯-১০০)
বিজ্ঞাপন
মৃত্যুর ভয় ও আখেরাতের চিন্তা থাকলে বেশি বেশি নেক আমলের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় অবৈধ ভোগবিলাসের দিকে আকর্ষণ থাকে না। তাই তো মহানবী (স.) বলেছেন, ‘সব ভোগ-উপভোগ বিনাশকারী মৃত্যুকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি: ২৪০৯)
আরও পড়ুন: আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ১৬ আমল
মৃত্যুর কথা যাদের স্মরণ হয় না, তাদেরকে নেককার লোকের সংস্পর্শে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। নেককার লোকের সংস্পর্শ শুধু মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না, হৃদয়ে ঈমানি চেতনা জাগ্রত করে এবং নেক আমলের হিম্মত ও প্রেরণা বৃদ্ধি করে। কারণ, নেককার ব্যক্তিদের ইবাদত-মগ্নতা, পুণ্যের কাজে উদ্যম ও প্রতিযোগিতা যখন কেউ প্রত্যক্ষ করে, তখন তার মধ্যেও পুণ্যের পথে চলার সাহস ও প্রেরণা জাগে। একইভাবে মানুষ যখন তাদের আল্লাহমুখিতা ও দুনিয়াবিমুখতা প্রত্যক্ষ করে, তখন তাদের মনেও এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের আগ্রহ জাগে।
মৃত্যুকে স্মরণ করার আরেকটি উপযুক্ত মাধ্যম হলো কবর জিয়ারত। কবর মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার পরিণামের কথা। মৃত্যুর পর আপনজনই তো কবর খনন করে। মৃতকে অন্ধকার ঘরে শায়িত করে। মাটির নিচে রেখে ফিরে আসে। তাই মৃত্যুর স্মরণের জন্য কবর জিয়ারত করতে উৎসাহিত করেছেন নবীজি (স.)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা কবর জিয়ারত করো। কারণ তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (মুসলিম: ৯৭৬)
মৃত্যুকে যারা বেশি স্মরণ করে এবং আল্লাহকে ভয় করে তাদের সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলা হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল। (সুরা ফাতির: ২৮)
এক হাদিসে নবীজি বলেন, ‘..যারা মৃত্যুকে বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তারাই সর্বাধিক বুদ্ধিমান।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৫৯)
আরও পড়ুন: প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি, এই হাদিসের অর্থ কী?
যারা পরকালের বিষয়ে গাফেল কিংবা অসচেতন তারা কোরআন ও নবীজির ভাষ্য অনুযায়ী নিতান্তই বোকা। তাদের সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা কীভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন দান করেছেন। আবার তোমাদের মৃত্যু দেবেন ও পুনরায় জীবন দেবেন এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে তোমরা তাঁর দিকেই ফিরে যাবে।’ (সুরা বাকারা: ২৮)
সুতরাং বুদ্ধিমান মুমিনরা সুখে-দুখে সবসময় মৃত্যুর কথা স্মরণে রাখবেন—এটি স্বাভাবিক। আর যারা মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে, স্বভাবতই তাদের মৃত্যুও সুন্দর হয়। কারণ মৃত্যুর ভয়ে তারা বিশুদ্ধ ঈমান ও নেক আমলের প্রতি সচেষ্ট ছিলেন। ফলে তাদের মৃত্যুটা হয় তোহফাস্বরূপ। শুধু জান্নাতে প্রবেশ করাটাই যেন বাকি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করার তাওফিক দান করুন। অন্তহীন জীবনের প্রস্তুতি হিসেবে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বেশি বেশি নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

