বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাজার নিয়ন্ত্রণে হাদিসের নির্দেশনা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০২:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

বাজার নিয়ন্ত্রণে হাদিসের নির্দেশনা

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি অমানবিক। এটি রোধ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো- জনদুর্ভোগ কমাতে বাজার দর স্থিতিশীল রাখা। তবে, উৎপাদকের দাম নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ইসলামের সাধারণ নীতি হলো- উৎপাদক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। তবে, বাজার মূল্য যদি কতিপয়ের মজুদ ও কারসাজির কারণে অস্বাভাবিক রকম হয় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন ইসলাম বাজার দর নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দিয়েছে। 

আনাস (রা.) বলেন, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (স.), দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনি আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণকারী, তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং তিনি জীবিকা দানকারী। আমি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার প্রাণ ও সম্পদের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫১)


বিজ্ঞাপন


শায়খ তাহির বাদাভি বলেন, ‘উল্লিখিত হাদিস মাধ্যমে ইসলামের নবী ঘোষণা দিচ্ছেন যে, বিনা প্রয়োজনে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা জুলুম। কিন্তু বাজারে যখন অস্বাভাবিক কার্যকারণ অনুপ্রবেশ করবে যেমন—কতিপয় ব্যবসায়ীর পণ্য মজুদকরণ এবং তাদের মূল্য কারসাজি—এ অবস্থায় সমাজের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদা পূরণার্থে এবং লোভীদের কাছ থেকে সমাজকে রক্ষায় মূল্য নির্ধারণ করা জায়েজ। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না দেওয়ার জন্য এ নীতি স্বতঃসিদ্ধ।’ (নিজামুল ইকতিসাদি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৭৮)  

আরও পড়ুন: মিথ্যা ছেড়ে দেওয়ার ইসলামিক উপায়

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না।’ (কিতাবুল মাজমু: ১২/১২১)

vegitable


বিজ্ঞাপন


ইসলামি শরিয়ত মূল্যবৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে। প্রধান কারণগুলো হলো—

১. মজুদদারি: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ মজুদদারি। বাজারে পণ্য সংকট থাকার পরও ব্যক্তি মুনাফার জন্য পণ্য গুদামজাত করে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষত তা যদি খাদ্যশস্য হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৫৫)

২. বাজার সিন্ডিকেট: বাজার দর নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা অসাধু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। ইসলামের নির্দেশনা হলো- পণ্য উৎপাদনের পর তা স্বাধীনভাবে বাজারে প্রবেশ করবে। বাজার মূল্য বৃদ্ধির জন্য তা আটকে রাখবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ২০৩৯৬)

৩. কালোবাজারি: কালোবাজারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হয়। কালোবাজারি সরাসরি প্রতারণা, জুলুম ও আর্থিক অসততার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেরা নিজেদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)

৪. মধ্যস্বত্বভোগী: মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারে না। ইসলাম পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণ পর্যন্ত মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করিম (সা.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’ (সহিহ বুখারি: ২১৬৬)

৫. কৃষির প্রতি অমনোযোগ: কৃষিকাজে অমনোযোগের কারণে খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। ইসলাম কৃষি ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা জমিনের পরতে পরতে জীবিকা অন্বেষণ করো।’ (মাজমাউল জাওয়ায়িদ)

আরও পড়ুন: ব্যবসায় সফল হতে চাইলে নবীজির ৭ নির্দেশনা মানুন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে মুমিনরা নানাভাবে তা প্রতিহত করতে পারে। যেমন—

এক. মূল্য নির্ধারণ: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেমন ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুই. বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন: ব্যবসায়ীদের অন্যায় মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজ বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন করতে পারে। কেননা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে গোশতের মূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা তাঁর কাছে অভিযোগ করে তার মূল্য নির্ধারণের দাবি জানায়। তিনি বলেন, তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তাদের কাছ থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও। (আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া: ৯/১৪১)

তিন. ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা: ব্যবসায়ীদের উচিত এমন কঠিন সময়ে ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা অবলম্বন করা। মহানবী (স.) বলেন, ‘আল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যে ক্রেতা, বিক্রেতা, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী অবস্থায় সহজতা অবলম্বনকারী ছিল। (সুনানে নাসায়ি: ৪৬৯৬)

ইসলামের দৃষ্টি দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার শাস্তি। তাই পাপ পরিহার করা এবং তাওবা করে দীনের পথে ফিরে আসা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে পার্থিব জীবনের এই সংকট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর