প্রিয়নবী (স.)-এর শুভাগমনের সময়টি মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। তিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীর কোরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে এবং নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। প্রিয়নবী (স.)-এর সৃষ্টি হয়েছে সবার আগে, কিন্তু আবদুল্লাহর ঔরসে মা আমিনার গর্ভ হয়ে পৃথিবীতে শুভাগমন করেছেন সকল নবীর শেষে।
আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে যখন (হে আবু মুহাম্মদ) বলে ইলহাম করলেন তখন তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ, আপনি আমার কুনিয়াত ‘আবু মুহাম্মদ’ কেন রেখেছেন? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমার মাথা উত্তোলন করো। তিনি মাথা উত্তোলন করে আরশ এবং এর চারপাশে রাসুল (স.)-এর নুর মুবারক দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই নুর কার? জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, এটি ওই নবীর নুর, যিনি তোমার সন্তানদের মধ্যে হবেন। তাঁর নাম আসমানে ‘আহমদ’ এবং জমিনে ‘মুহাম্মদ’(স.)। তিনি যদি না হতেন তবে আপনাকে সৃষ্টি করতাম না, আসমান আর জমিনও সৃষ্টি করতাম না। (ইমাম শিহাব উদ্দিন কাস্তালানি, আল মাওয়াহিবু লাদুনিয়া, ১/৫৭)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: নবীজির আদর্শের অনুসরণ মুক্তির মূলমন্ত্র
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার নবুয়ত কখন অবধারিত হয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, যখন তিনি আদম (আ.) শরীর ও রুহের মধ্যে ছিলেন। (সুনানে তিরমিজি: ৩৬০৯)
রাসুল (স.) এর শুভাগমনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর শুভাগমনের ৫০ অথবা ৫৫ দিন আগের একটি ঘটনা হলো আসহাবে ফিল বা হাতির ঘটনা। এছাড়াও বহুদিন ধরে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত আরব নবীজি (স.)-এর বরকতময় জন্মের বছর ফলে-ফুলে, পত্র-পল্লবে সজীব হয়ে ওঠেছিল। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। একই বছর আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ায় কোরাইশরা নবীজি (স.)-এর শুভজন্মের এ বছরকে ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ (বিজয় ও আনন্দের বছর) হিসেবে নামকরণ করেছিল।
ফাতিমা বিনতে আবদিল্লাহ (রা.) বলেন, যখন প্রিয়নবী (স.)-এর শুভাগমন ঘটল, তখন আমি আমিনার কাছে উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম সব গৃহ উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেছে এবং এ-ও দেখলাম, আসমানের তারকারাজি এত কাছে এসেছে যে আমার মনে হলো এই তারকা আমার ওপর পতিত হবে। (ফাতহুল বারি, ৬/৪২৬)
বিজ্ঞাপন
আমিনা আরো বলেন, আল্লাহ তাআলা ওই সময়ে আমার চোখের পর্দা উঠিয়ে নেন আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্ত দেখতে পেলাম। ইরবাস ইবনে সারিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.)-এর শুভ জন্ম গ্রহণকালীন সময়ে তাঁর মাতা এক নুর দেখেন, যাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়। (ইমাম হাকেম, আল মুসতাদরাক, মেশকাত: ৫৭৫৯)
আরও পড়ুন: তায়েফে নবীজির ওপর অমানবিক আচরণ
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি তোমাদের আমার প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে বলছি। আমি হলাম ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ। আর আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসব করার সময় দেখেছিলেন যে এমন এক নুর উদ্ভাসিত হয়েছে, যার দ্বারা আমার আম্মাজানের জন্য সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল। (ইমাম বায়হাকি, দালায়েলুন নবুয়ত, পৃষ্ঠা-৩৫)
রাসুল (স.)-এর শুভাগমনের সময় আশ্চর্য ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে হাসসান বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমি সাত বা আট বছরের শিশু ছিলাম, আমি যা দেখতাম এবং শুনতাম তা অনুধাবন করতে পারতাম। একদিন সকালে এক ইহুদি চিৎকার করে বলতে লাগল, হে ইহুদি সম্প্রদায়, তোমাদের জন্য ধ্বংসের কথা হলো যে আহমদ এর তারকা উদিত হয়েছে, আজ রাতেই তার শুভাগমন ঘটেছে। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মক্কা শরিফে এক ইহুদি বাস করত। যে রাতে প্রিয় রাসুল (স.) তাশরিফ এনেছিলেন তখন সে বলল, হে কোরাইশ দল, আজ রাতে কি তোমাদের কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেছে? তারা বলল, আমাদের জানা নেই। তখন সে বলল, দেখো, আজ এই উম্মতের নবী তাশরিফ এনেছেন। যাঁর দুই স্কন্দের মাঝে নবুয়তের চিহ্ন রয়েছে। তিনি দুই রাত পর্যন্ত দুধ পান করবেন না। লোকজন দ্রুত ওই সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল যে আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। ইহুদি বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাও। ইহুদি তার দুই বাহুর মাঝখানে ওই মোহরে নবুয়ত চিহ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফিরে আসার পর সে বলল, নবুয়ত বনি ইসরাঈল থেকে চলে গেছে। হে কোরাইশ সম্প্রদায়, শোনো, এই নবীর ওসিলায় তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তাঁর শুভাগমনের সংবাদ পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে। (ইমাম হাকেম, আল মুস্তাদরাক: ৪১৭৭)
আরও পড়ুন: নবীজির ঘরবাড়ি কেমন ছিল
পবিত্র কোরআন মজিদে প্রায় ১০টি সুরায় রাসুল (স.)-এর শুভাগমন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে (বোরহান) অকাট্য প্রমাণ এসেছে, আর আমি সমুজ্জ্বল আলোকময় নুর পাঠালাম।’ (সুরা আন নিসা: ৪১)
তাফসিরে কবির, তাফসিরে রুহুল বয়ান প্রভৃতি তাফসির গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, বোরহান বা অকাট্য প্রমাণ বলে নবীজি (স.)-কে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে হাবিব) আমি আপনাকে জগৎসমূহের প্রতি একমাত্র রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির পবিত্র সিরাত বেশি বেশি পড়ার ও জানার তাওফিক দান করুন। আমিন।