কোনো মুসলমানকে কাফের বলা জায়েজ নয়। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘একজন যেন অন্যজনকে ফাসিক বলে গালি না দেয় এবং একজন যেন অন্যজনকে কাফের বলে অপবাদ না দেয়। কেননা, অপরজন যদি তা না হয়, তবে সে অপবাদ তার নিজের ওপর আপতিত হবে।’ (বুখারি: ৬০৪৫) এ বিষয়ে নবীজির আরও হাদিস রয়েছে। এক হাদিসে আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘কেউ তার ভাইকে ‘কাফের’ বলে সম্বোধন করলে উভয়ের একজনের ওপর তা ফিরে আসবে। যাকে ‘কাফের’ বলা হয়েছে সে কাফের হলে তো হলোই, নতুবা কথাটি বক্তার ওপর ফিরে আসবে। (বুখারি: ৬৪০৪)
সত্যিকার অর্থে কারো থেকে কুফুরি প্রকাশ পেলেও তাকে তাকফির করা বা কাফের ঘোষণা দেওয়া সাধারণ মানুষের কাজ নয়। মুফতিয়ানে কেরাম ওই ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই করে তাকফিরের মূলনীতি সামনে রেখে কাফের ফতোয়া দেবেন। ফতোয়ায়ে লাজনাতুদ দায়েমাতে আছে— ‘কাউকে কাফের বলার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো- প্রমাণ থাকা, সতর্কতা অবলম্বন করা এবং দলিল স্পষ্ট না হলে দ্রুত তাকফির না করা।’ (ফতোয়া নম্বর: ৪৪৪৬)
বিজ্ঞাপন
শরহে আকিদাতুত তাহাবিতে আছে, ‘তাকফিরের কাজের আঞ্জাম শুধু তারাই দেবেন, যাদের ইলেমে গভীরতা রয়েছে।’ (ফতোয়ায়ে লাজনাতুদ দায়েমা, পৃষ্ঠা-৯২)
তবে, শরিয়তের দৃষ্টিতে অমুসলিমরা স্পষ্টতই বেঈমান বা কাফের। তাদের কুফরকে কেউ কুফর মনে না করলে অথবা তাদের কুফরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ঈমান চলে যাবে। এ বিষয়ে কাজি ইয়াজ (রহ.) ইজমা বর্ণনা করেছেন, ‘এ ব্যাপারে আলেমরা একমত যে, যে ব্যক্তি কোনো ইহুদি-খ্রিস্টানকে কাফের বলে না অথবা তাদের কাফের বলা থেকে বিরত থাকে কিংবা তাদের কুফরে সন্দেহ পোষণ করে সেও সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। (আশ শিফা: ২/২৮১)
আরও পড়ুন: ঈমান মজবুত করবেন যেভাবে
ইমাম আবুল মাআলি (রহ.) বলেন, ‘কোনো কাফেরকে মুসলিম বলে চালিয়ে দেওয়া এবং কোনো মুসলমানকে দ্বীন থেকে বের করে দেওয়া উভয়টাই জঘন্য।’ (ইকফারুল মুলহিদিন: ২৭)
আবার, কাউকে তাকফির করা তথা কাফের ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে খারেজিদের মতো বাড়াবাড়ি করা যাবে না। একইভাবে মুরজিয়াদের মতো ছাড়াছাড়ি করে কাফের বা মুরতাদকে মুসলিম আখ্যা দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মূলনীতির অনুসরণ করতে হবে। (শরহে আকিদাতুত তাহাবি, পৃষ্ঠা-৯১)
বিজ্ঞাপন
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মূলনীতি অনুযায়ী, কারো থেকে কুফর প্রকাশিত হলেও তার মধ্যে কিছু বিষয় পাওয়া গেলে তাকে কাফির বলা যায় না; বরং শুধু তার কাজটাকে কুফরি বলা হয়। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর নির্দিষ্টভাবে কুফরির হুকুম আরোপ করা যায় না। বরং বলা হবে, যে ব্যক্তি এ কাজ করেছে সে কাফির। অথবা বলবে, এই কাজটি কুফর।’ (মাজমুউল ফতোয়া)
যেসব বিষয়ের কারণে কাউকে কাফের বলা যায় না—সেগুলোকে পরিভাষায় বলা হয় ‘মাওয়ানেউত তাকফির’ তথা কাফির বলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। এগুলো মোট সাতটি।
১. অজ্ঞতা: জমহুর উলামায়ে কেরাম অজ্ঞতাকে ওজর হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু জরুরতে দ্বীন তথা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াবলী (যেমন: নামাজ, পর্দা, হজ ইত্যাদির) ক্ষেত্রে এ ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। (ইকফারুল মুলহিদিন: পৃষ্ঠা-৭১)
২. তাবিল তথা ব্যাখ্যা পেশ করা: কেউ যদি তার কুফরির বিষয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পেশ করে অথবা তার কুফরিটি সন্দেহপূর্ণ হয় তাহলে তাকে তাকফির করা যাবে না। তবে জরুরতে দ্বীনের (ইসলামের মৌলিক বিষয়ের) ক্ষেত্রে তাবিল বা ব্যাখ্যা ওজর ধরা হবে না। (ইকফারুল মুলহিদিন, পৃষ্ঠা-৭১)
৩. ইকরাহ তথা কুফরিতে বাধ্যকরণ: জীবননাশের আশঙ্কা থাকা অবস্থায় কাউকে কুফরিতে বাধ্য করার কারণে তার থেকে যে কুফর প্রকাশ পায় তা ওজর হিসেবে গণ্য হবে। (সুরা নাহাল: ১০৬)
৪. ভুল করা: কেউ ভুলবশত মুখে কুফরি উচ্চারণ করে ফেললে তাকে তাকফির (কাফির বলা) করা যাবে না। (সুরা আহজাব: ৫, ইবনে মাজাহ: ২০২৩)
৫. অক্ষমতা: নির্জন মরুভূমি বা দ্বীপে থাকার কারণে যার কাছে দ্বীনের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিষয় পৌঁছেনি, তাকে তাকফির করা যাবে না। (কিতাবুল ঈমান)
৬. নতুন ইসলাম গ্রহণ। (তিরমিজি: ২১৮০)
৭. বড় কুফর প্রতিরোধে ছোট কুফর করা। (বুখারি: ৩০৩১)
মনে রাখা জরুরি, কাউকে অযথা কাফের বলা আর মানুষ হত্যার মধ্যে পার্থক্য নেই। সহিহ বুখারির বর্ণনায় নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুমিনকে কুফরের অপবাদ দেওয়া, তাকে হত্যা করার মতোই। (সহিহ বুখারি: ৬১০৫) সুতরাং এ ব্যাপারে সবার সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কাউকে কাফির বলার আগে উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

