শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

বিতির নামাজ কি শুধু এক রাকাত পড়লেও হয়?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২৩, ০৬:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

বিতর নামাজ কি শুধু এক রাকাত পড়লেও হয়?

আরবি বিতির বা বিতর অর্থ বিজোড়। এজন্যই বিতির নামাজকে বিতর বলা হয়। এশার নামাজের পর থেকে ফজরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত বিতির নামাজের সময়। সাধারণত এশার নামাজের পরে বিতির পড়ার নিয়ম। তবে শেষরাতে ইবাদতের ইচ্ছা ও ঘুম থেকে জাগার প্রবল সম্ভাবনা থাকলে তাহাজ্জুদের পরেই বিতির পড়া উত্তম। মহানবী (স.) সাধারণত তাহাজ্জুদের পর বিতির নামাজ পড়তেন।

হানাফি মাজহাবে বিতির নামাজ এক রাকাত পড়ার বিধান নেই। তিন রাকাতই পড়তে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসুল (স.) বিতিরের নামাজ তিন রাকাত আদায় করতেন।’ (সুনান দারু কুতনি: ১৬৫৯; বাদাইয়েউস সানায়ি, খণ্ড: ০১, পৃষ্ঠা-২৭২)


বিজ্ঞাপন


‘আম্রা বিনতে আবদুর রহমান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বিতির নামাজ তিন রাকাত পড়তেন। প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করতেন।’ (আলমুসতাদরাক আলাস সহিহাইন: ১/৩০৫, হাদিসটি সহিহ)

সায়িদ ইবনে জুবাইর (রহ) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বিতির নামাজ তিন রাকাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাছ পড়তেন।’ (দারেমি: ১/৩১১, হাদিস: ১৫৯৭; তিরমিজি: ১/৬১; নাসায়ি: ১/২৪৯; ইবনে মাজাহ পৃ-৮৩; শরহু মাআনিল আছার তাহাবি: ১/১৪০; মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১/২৯৯)

ইমাম নববি (রহ) ‘খুলাসা’ কিতাবে বলেন, হাদিসটি সহিহ সনদে বর্ণিত। (নাসবুর রায়া: ২/১১৯)

আবদুল্লাহ ইবনে আবি কাইস বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম যে নবীজি (স.) বিতিরে কত রাকাত পড়তেন? জবাবে তিনি বলেন, চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, ১০ এবং তিন। তিনি বিতিরে সাত রাকাতের কম এবং ১৩ রাকাতের বেশি পড়তেন না। (সুনানে আবু দাউদ: ১/১৯৩, হাদিস ১৩৫৭ (১৩৬২); তাহাবি: ১/১৩৯; মুসনাদে আহমদ: ৬/১৪৯, হাদিস: ২৫১৫৯)


বিজ্ঞাপন


এই হাদিসে দেখা যাচ্ছে- রাসুলুল্লাহ (স.) তাহাজ্জুদ নামাজ কখনো চার রাকাত, কখনো ছয় রাকাত, কখনো আট রাকাত, কখনো ১০ রাকাত পড়তেন; কিন্তু মূল বিতির সর্বদা তিন রাকাতই হতো। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) ‘ফাতহুল বারি’তে ৩/২৬-এ লেখেন, আমার জানামতে এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বর্ণনা। এ বিষয়ে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এর দ্বারা সেসবের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব। (ফাতহুল বারি: ৩/২৬)

আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, রমজানে নবীজির নামাজ কেমন হতো? জবাবে তিনি বলেন, রমজানে এবং রমজানের বাইরে রাসুল (সা.) ১১ রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না! এরপর আরো চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তো বলাই বাহুল্য! এরপর তিন রাকাত (বিতর) পড়তেন। (সহিহ বুখারি: ১/১৫৪, হাদিস ১১৪৭; সহিহ মুসলিম: ১/২৫৪, হাদিস ৭৩৮; সুনানে নাসায়ি ১/২৪৮, হাদিস ১৬৯৭)

উল্লেখিত সবগুলো বর্ণনা অনুযায়ী বিতির তিন রাকাত হলেও কিছু হাদিসের আলোকে বিতির নামাজ এক রাকাত পড়লেও সমস্যা নেই—এমনটি মনে করেন অনেক আলেম। যেমন একটি হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) রাতের তাহাজ্জুদের নামাজ দুই দুই রাকাত করে আদায় করতেন এবং এক রাকাত বিতির পড়তেন। (বুখারি: ৯৩৬)

আরেকটি হাদিসে আবদুল্লাহ  ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাতের নামাজ দুই দুই রাকাত করে। আর যখন তুমি নামাজ শেষ করতে চাইবে, তখন এক রাকাত বিতির পড়বে। এতে তোমার আদায়কৃত নামাজে বিতিরের নামাজও হয়ে যাবে। (বুখারি: ৯৩৪)

হানাফি মাজহাবের আলেমদের মতে, এসব হাদিস দ্বারা বুঝায় না যে, বিতির শুধুমাত্র এক রাকাত। বরং শেষের দুই রাকাতকে বিজোড় করার জন্য একরাকাত যোগ করা বুঝায়। অর্থাৎ শেষের দুই রাকাতের সাথে এক রাকাত যোগ করে তিন রাকাতই বিতির পড়তেন নবীজি। এসব বর্ণনা মূলত এক রাকাত বিতিরের দলিল নয়। বরং তিন রাকাত বিতিরেরই দলিল। তাই বিতির নামাজ এক রাকাত নয়, তিন রাকাতই পড়তে হবে। সাদ ইবনে হিশাম বলেন, ‘আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) তিন রাকাতে বিতির পড়তেন এবং শেষ রাকাতের পূর্বে সালাম ফেরাতেন না’। মুসতাদরাকে হাকেমের বর্ণনায় রয়েছে, ‘হজরত ওমর (রা.)-ও বিতির এভাবে পড়তেন এবং তাঁর কাছ থেকেই মদিনাবাসী এ আমল গ্রহণ করেছে।’ (আলমুসতাদরাক: ১/৩০৪ হাদিস: ১১৮১; তাহাবি: ১/১৯৩; নাসায়ি: ১/২২৮, হাদিস: ১৬৯৮; ইবনে আবি শাইবা: ৪/৪৯৩-৪৯৪ হাদিস: ৬৯১৩; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদিনা: ১/১৩৭ ৩/২১৪)

ইমাম হাকেম, জাহাবি, আইনী, নববি ও আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী প্রমুখ হাদিসটি সহিহ বলেছেন। বিখ্যাত অনেক হাদিসবিশারদই এটিকে সহিহ বলেছেন। (আত্তারিফ: ৪/৪৪০)

হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম ইবনুল জাওযী, ইমাম জাহাবি ও ইবনে হাযম জাহেরি (রহ) প্রমুখ বলেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায় নবীজির বিতির নামাজ ছিল তিন রাকাত এক সালামে। তবে তাতে মাগরিবের নামাজের মতো মাঝে বৈঠক করতেন। (আত্তানকিহ লিজ জাহাবি: ১/৩২৬; আল-মুহাল্লা: ২/৮৯ আত্তাহকিক ফি মাসায়িলিল খিলাফ ও আততানকিহ লি ইবনে আব্দিল হাদি)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, দিনের বিতির হল মাগরিবের নামাজ। তোমরা রাতের নামাজকেও অনুরূপ বিতির করে পড়। (মুসনাদে আহমদ: ৪৮৪৭, এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, শুয়াইব আরনাউত। ইবনে আবী শাইবা: ৪/৪ হাদিস: ৬৭৭৩, ৬৭৭৮ আব্দুর রাজজাক: ৪৬৭৫ তাবারানি: সগির ও আওসাত)

ইমাম মুহাম্মদ (রহ) বলেন, ‘আমরা এ বর্ণনাটি গ্রহণ করি। যে ব্যক্তি ইবনে ওমরের বক্তব্য অনুসারে বিতিরকে মাগরিবের নামাজের অনুরূপ মনে করে, তার উচিত মাগরিবের মতোই বিতির পড়া। যাতে দুই রাকাতের পর সালাম ফিরাবে না। এটিই ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর মত। (মুয়াত্তা মালেক: ইমাম মুহাম্মদের বর্ণনা পৃ-১৪৯)

বিতির নামাজের নিয়ম
বিতির নামাজ প্রায় অন্য ফরজ নামাজের মতো। তবে নিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা আছে। দুই রাকাত নামাজ পড়ে প্রথম বৈঠকে বসে তাশাহহুদ পড়তে হয়। কিন্তু সালাম ফেরানো যাবে না। সাদ ইবনে হিশাম (রহ.) বর্ণনা করেন, আয়েশা (রা.) তাকে বলেছেন, রাসুল (স.) বিতিরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। (সুনানে নাসায়ি ১/২৪৮; হাদিস ১৬৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৪/৪৯৪, হাদিস ৬৯১২)

এরপর তৃতীয় রাকাত পড়ার জন্য উঠে সুরা ফাতেহা, এরপর অন্য কোনো সুরা বা আয়াত মিলাতে হয়। কেরাত (সুরা বা অন্য আয়াত মিলানোর পর) শেষ করার পর তাকবির বলে দুহাত কান পর্যন্ত উঠাতে হয় এবং তাকবিরে তাহরিমার মতো হাত বেঁধে নিঃশব্দে (অনুচ্চঃস্বরে) দোয়া কুনুত পড়তে হয়। দোয়া কুনুত পড়ে আগের মতো রুকু-সেজদা করতে হয়। তারপর শেষ তাশাহহুদ, দরুদ, দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হয়।

বিতিরের নামাজের এই পদ্ধতি বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে এবং সাহাবিদের আমলের মাধ্যমে প্রমাণিত। হাদিসে এসেছে, ‘..রাসুলুল্লাহ (স.) তিন রাকাতের দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহুদের জন্য বসতেন, কিন্তু সালাম ফেরাতেন না। বরং তৃতীয় রাকাতে সবশেষে সালাম ফেরাতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-ও এভাবে বিতর পড়তেন। তার সূত্রে মদিনাবাসীরাও বিতর নামাজ এভাবে গ্রহণ করেছেন। (মুস্তাদরাক আলাস সহিহাইন: ১/৩০৪, হাদিস: ১১৮১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নাহ অনুযায়ী বিতর পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। বিতির নামাজ কত রাকাত? বিতির নামাজ এক রাকাত, বিতির অর্থ বিজোড়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর