শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মানুষের দাম কত

অমিয় দাশ
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

মানুষের দাম কত

সেদিন হঠাৎ করেই এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল অংশুর। ওর মেয়ে বন্ধু। বান্ধবী বললে লোকজন মনে করে মেয়েটি বোধহয় অংশুর প্রেমিকা। আবার বন্ধু বললে কেমন যেন আক্ষরিক হয় না।

অংশুও মেয়েটির ছেলে বন্ধু। কদাচিৎ কিঞ্চিৎ দেখা হয়। ওদের বয়সের পার্থক্য বছর তিনেকের। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের হিসেবে অংশু তিন বছরের বড় মেয়েটির থেকে। অংশুর সাতাশ, আর ওর মেয়ে বন্ধু চব্বিশের কোঠায়। ওর নাম বাঁধন। বাঁধনের সাথে অংশুর প্রথম দেখা হয় এক আড্ডাতে। ওর বোন অংশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ছাত্রী ছিল। যদিও ওর বোনটি অংশুর থেকে এক বছরের ছোট, তবুও মাঝে মাঝে দেখা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।


বিজ্ঞাপন


বাঁধন সবসময় ওর বোনের সাথে লেপ্টে থাকে। বোন আছে মানে সাথে বাঁধনও আছে। বাঁধন অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে। তবুও সবাই ওকে অংশুদের একজন হিসেবেই জানে। মেয়েটি সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য, চারুকলা এসব কোনো কিছুতেই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে না, তবে ও একজন ভালো শ্রোতা ও দর্শক।

খুব হাসে মেয়েটা, যেন জীবনের কোনো দুঃখ, সীমাবদ্ধতা ওকে স্পর্শ করেনি, করতে পারে না। কারণে অকারণে হাসে। হাসলে ওর চকচকে দাঁতগুলো যেন হাসিটাকে আরও সমৃদ্ধ করে, ওর হাসির সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দেয়। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে, হাসি আরও হাসি আনে, সুখ আরও সুখ আনে। মানুষের হাঁসি একটি সংক্রামক বিষয়। হাসি চারপাশ সংক্রমিত করে আরও হাসি নিয়ে আসে। কেউ যদি আপন আনন্দে হাসে, আশপাশে থাকা গোমড়ামুখগুলোরও মনের গভীরে হাসিহাসি ভাব হয়। যখন আশপাশের সবাই আড্ডা মেরে হাসাহাসি করে, বাঁধন সবার সাথে এক ধাপ এগিয়ে আরও জোরে হেসে কুটিকুটি। এমন একটা ব্যাপার যে রসাত্মক কথাটা যেন ওর উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে!

যারা অনেক হাসতে পারে তারা অনেক তাড়াতাড়ি বন্ধু হতে পারে। বাঁধনও এভাবেই অংশুর একজন মেয়ে বন্ধু হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে খেয়াল করেছে যে অন্যরা একটু আড়চোখে দেখে ওদের এই বন্ধুত্বটাকে। ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব হতে পারে— এ যুগেও অনেকের সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। আরও কষ্ট হয় যদি কিনা বাঁধনের মত প্রাঞ্জল সুন্দরী মেয়ের সাথে একটা ছেলের বন্ধুত্বের বিষয় আসে। বাঁধন ডাকসাইটে সুন্দর না হলেও বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য বলতে আমরা যা বই পুস্তকে পড়ি তার সবটাই তার আছে।

 


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন 

ওর ভ্রু জোড়া স্রষ্টা দারুণভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার যেভাবে প্রতিটি ফুল গাছ কিংবা বাগানের গাছপালা যত্নের সাথে ছাঁটাই করে শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতন করে রাখে, প্রকৃতি সেভাবেই ওর ভ্রু জোড়ার একটা একটা চুলকে ঠিক ঠিক স্থান মতো লাগিয়েছেন। চোখ দুটি ফোলা ফোলা। দেখলে মনে হয় এইমাত্র দুপুরের দিবানিদ্রা শেষ করে উঠে এলো। সামনের উপরের পাটির দাঁতগুলো সামান্য উঁচু। এতে ওর ঠোট দুটো অল্প ফাঁকা থাকে, হাঁসি হাঁসি অধিকাংশ সময়। মডেলরা যেভাবে ইচ্ছা করে ক্যাটওয়াকে ঠোট খুলে হাটে, সেরকম। বাধঁন জানে ওর চোখ দুটো সুন্দর। তাই কাজল কিংবা চোখের কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করে না।

অংশু একদিন কৌতূহলবশত ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই বাঁধন, তুমি চোখের কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করো না কেন?’

‘কেন চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করলে কি হতো?’

‘অনেকেই ব্যবহার করে, তাই বললাম।’ বলেই অংশু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বিষয়টাকে হাল্কা করার চেষ্টা করল। চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করলে হয়তো আরও সুন্দর দেখাতো— এটা বলার সাহস হলো না।

‘আমার চোখ এমনিতেই সুন্দর!’

আড়চোখে তাকিয়ে বাঁধন বলেছিল, ‘আপনার চোখে আইশ্যাডো লাগালে যদি আরও সুন্দর দেখায় তাহলে আপনি কি আইশ্যাডো লাগাবেন? দ্যাখেন, ছেলেদের চোখেরও অনেক সৌন্দর্য আছে।’

‘তাই নাকি? জানতাম না তো!’ বলেই বাঁধনের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার উৎসুকের মতো জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেদের চোখের সৌন্দর্যের বিষয় নিয়ে তেমন কিছু শুনি না, তুমি কি ছেলেদের চোখের এই বিষয়টা কোথাও শুনেছো বা পড়েছো?’

জিজ্ঞেস করেই হা করে বাঁধনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো উত্তরের অপেক্ষায়।

‘অবশ্যই শুনেছি, পড়েছি এবং দেখেছি। এই ধরুন, নায়কের মতো চোখ, ভিলেনের মতো চোখ, মিথ্যাবাদীর মতো চোখ, মাতালের মতো চোখ, টেরা চোখ, ইত্যাদি। তারপর বোকা বোকা চোখও আছে, যেমন, এই মুহূর্তে আপনার চোখ সেরকম মনে হচ্ছে!’ বলেই মিটমিট করে হাসলো। অংশু গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কয়েক সেকেন্ড পরে বিষয়টা আঁচ করতে পারলো যে তাকে নিয়ে বলা হয়েছে। আর বুঝেই হা হা করে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির তোড়ে চেয়ার কেঁপে মেঝের টাইলের উপরে কুছ্ কাচ্ শব্দও হলো। আশপাশে তাকিয়ে অংশু দেখল বসা-দাঁড়ানো অনেক মানুষের চোখ ওর উপরে। সবার দৃষ্টি কেন ওর উপরে তা বুঝতে একটু সময় লাগলো।

তাই তো, বাঁধনের কথা অন্য আর কেউ তো শোনেনি। মনে মনে ভাবল ওরা শুনলে নিশ্চয়ই অংশুর মতোই মজা পেতো।

‘অনেক জোরে হাসলে আপনার চোখ জাপানি বাচ্চাদের মতো দেখায়।’ বলেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কুটিকুটি হেসে টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। মাঝে টেবিল না থাকলে হয়তো অংশুর গায়ের উপরই আছড়ে পড়ত। অংশু ছেলেদের চোখের এরকম আজব বর্ণনা জীবনে কখনো শোনেনি।

আরও পড়ুন

কে সেই জনগণ!

আজ অংশু ও বাঁধন ইউনিভার্সিটির পাশে একটা ক্যাফেতে একটা টেবিল নিয়ে সামনাসামনি বসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাখানা এই ক্যাফে। অংশু একটি সংস্কৃতি সংঘের সদস্য। ও মাঝে মাঝে এখানে আসে, সবার সাথে দেখা করতে বা আড্ডা মারতে। ওদের নাটকের কোনো রিহার্সেল থাকলে এখানে সবাই সমবেত হয়ে তারপর রিহার্সেল স্থানের দিকে রওনা হয়।

অংশু দুটো কফির অর্ডার দিয়ে স্থির হয়ে বসল। আজ বাঁধনের মনটা অন্য দিনের মতো ফুরফুরে না। সাথে ওর বোনটাও নেই। অংশুর একটু খটকা লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বাঁধন সব ঠিকঠাক?’

‘হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক’। নরম সুরে বাঁধন বলল।

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বাঁধন অংশুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘অংশু ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?

‘হ্যাঁ। কি প্রশ্ন ?’

‘একটা মানুষের প্রাইস বা মূল্য কত?’

হঠাৎ এরকম একটা জটিল প্রশ্ন শুনে অংশু আশ্চর্য হয়। বলে, ‘এটা একটা খুব দামী এবং আপেক্ষিক প্রশ্ন। যদি সত্যিই জানতে চাও তাহলে আমার মতে এরকম হবে…’ একটু থেমে আবার বলে, ‘প্রথমে আমার নিজের কত মূল্য সেটা দিয়ে শুরু করি।

‘আপনার মূল্য কত?’

‘আমার মূল্য আমার মায়ের কাছে একরকম, আবার তোমার কাছে একরকম’, বলেই একটু মুচকি হাসল।

বাঁধন জিজ্ঞেস করে, ‘হুম, তাহলে সন্তানের কাছে বাবা বা মায়ের মূল্য কত?’

‘বাবা-মায়ের কাছে প্রতিটা সন্তান অমূল্য। অর্থাৎ একজন মা তার গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে যে মূল্য দেবে, প্রতিটি মা ঠিক একই মূল্য দেবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটার পরিমাণ বের করা যাবে না। অন্যভাবে বললে, তোমার কাছে তোমার মা-বাবার যে মূল্য, আমার কাছেও আমার মা-বাবার একই মূল্য।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘প্রত্যেকটা জিনিসের মূল্য আবার স্থান, কাল, পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। একটা চেয়ারের লবণাক্ত, আর্দ্র জায়গায় বা দেশে যা দাম হবে, শুষ্ক মরুভূমি এলাকায় সেই একই চেয়ারের দাম ভিন্ন হবে। কারণ, ওই নির্দিষ্ট প্রকারের কাঠের চেয়ারের স্থায়িত্ব কম বা বেশি হবে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদির প্রভাবে। তাই একই জিনিসের মূল্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে।

একটি জিনিসের মূল্য হচ্ছে যে ওই জিনিসের কাছ থেকে ক্রেতা বা মূল্য নির্ধারণকারী কতটুকু উপযোগিতা পাচ্ছে তার ওপর। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসের একটা মূল্য আছে। মূল্য হলো একটি বস্তু পেতে গেলে কি পরিমাণ স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের সম্মুখীন হবে তার সমতুল্য। যদি স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে মূল্য বেশি হয় তবে সেই বস্তুটা হবে মাত্রাতিরিক্ত দামী বা ওভারপ্রাইসড।

আরও পড়ুন

 

অংশু ইতস্তত করলো। আজকাল বখাটে ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদেরকে টিজিং করার সময় ‘জিনিস’ বলে। তবুও বলে চললো, কোনো জিনিস ক্রয় করার আগে তুমি সবসময় মূল্যের কথা চিন্তা করো। মূল্যটা যদি তোমার স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে বেশি হয় তবে ওই জিনিস কিনে তুমি খুশি হবে। আবার মূল্য যদি বেনিফিট বা উপযোগিতার চেয়ে কম হয় তবে সেটা কিনে তুমি মনে করবে যে তুমি ঠকেছো।’

‘হ্যাঁ, বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখিনি।’

বাধঁন আগ্রহভরে বলল, ‘মনে করো আমি একটা শাড়ি কিনে তোমাকে উপহার দেব। ধরো, সেই শাড়িটির মূল্য ১০০ টাকা।’

‘মাত্র ১০০ টাকার শাড়ি?’ বলেই বাধঁন অংশুকে থামিয়ে দিল।

‘তুমি কি আমার এতক্ষণের বকবক শুনেছিলে, নাকি হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে?’, বলেই অংশু বাধঁনের দিকে আবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ‘শুনছিলাম আর ভাবছিলাম’। ‘কি ভাবছিলে’? ‘একি গোলকধাঁধা? মূল্যের সাথে উপযোগিতার সম্পর্কের কথা। মানুষের যদি উপযোগিতা থাকে তবে সজীবের কাছে আমার উপযোগিতা কি তাই ভাবছিলাম।’ সজীব বাঁধনের প্রেমিক, তবে এখন একটু মন কষাকষি চলছে।

‘হুম, সেটা একটা ভাবার বিষয় বটে। যেমন বললাম, মূল্য নির্ধারিত হয় স্থান, কাল, পাত্র ভেদে। এখানে সজীব হলো পাত্র বা দরদামকারী। কিন্তু এর সাথে স্থান ও কাল জড়িত আছে।

‘তবে সজীব সম্পর্কে আমি তেমন বিশেষ কিছু জানি না। জানলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখতে পারতাম।’

‘সজীবের সম্পর্কে দেখি বলবো আপনাকে।’, বলেই বাধঁন অন্যমনষ্কের মতো অংশুর দিকে তাকিয়ে আবার তাড়া দিলো, ‘আপনি কিন্তু আমার মূল্যায়ন শেষ করলেন না।’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, বলেই বিজ্ঞের মতো বর্ণনা শুরু করল। মনে করো একটি শাড়ির মূল্য তাহলে ১০ হাজার টাকা, যেটা আমি দোকানে কিনতে গিয়েছি তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য। এখন ওই শাড়িটার বিনিময় মূল্য হলো ১০ হাজার টাকা। তার মানে আমার পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে উপহার দেব। এখন ওই শাড়িটা ক্রয়ের ফলে আমি কি উপযোগিতা পাবো?’

‘হ্যাঁ, ১০ হাজার টাকার শাড়ি কিন্তু দেখতে সুন্দর হবে। কিন্তু আমার কাছ থেকে আপনি কি উপযোগিতা পাবেন বলে আপনার মনে হয়?’

‘এখানে উপযোগিতা বলতে শাড়িটা পেয়ে তুমি খুশি হবে। শাড়িটা কি উপলক্ষে পরা যায় তা নিয়ে চিন্তা করবে। এটির সাথে রং মিলিয়ে ব্লাউজ বানাবে, চুড়ি কিংবা মাটির মালা কিনবে। হয়তো জুতা বা হিল স্যান্ডেল কিনবে। এসব চিন্তা করে তোমার কিছু ভালো সময় কাটবে। এসব ভালো সময় কাটানোরও কিছু মূল্য আছে।’

‘আর এক্ষেত্রে আপনার উপযোগিতা?’

‘আমার উপযোগিতা হলো তুমি আরো বেশি করে খিল খিল করে প্রাণ খুলে হাসবে। তোমার গায়ে শাড়িটা তোমাকে আরো উজ্জল করবে, এই আর কি।’

বাধঁন ভাবে, এভাবে তাকে কেউ কখনো বলেনি। এরকম কারো ভাবনা হতে পারে, একটু উদ্ভট। যাকগে।

‘হ্যাঁ, এবার বলুন শাড়ির বিষয়টা।’

‘মূল্য হচ্ছে, ওই শাড়িটা কতটুকু উপযোগিতা দিতে সক্ষম হবে। যদি বিনিময় মূল্য উপযোগিতার চেয়ে কম হয়, তবে দোকানি আমার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে।’

‘তা কি করে হবে?‘, বাধঁন জিজ্ঞেস করে।

‘ধরো, শাড়িটি উপহার হিসেবে পেয়ে তুমি বললে, রঙটা কচি কলাপাতার রং না হয়ে গাঢ় নীল হলে ভালো হতো। অথবা পাড়-আঁচল গোলাপী না হয়ে মেরুন হলে ভালো হতো। তাহলে আমি বুঝতাম শাড়িটি তোমার পছন্দ হয়নি। তার মানে শাড়িটার উপযোগিতা ১০ হাজার টাকার সমান নয়। আমি ঠকেছি শাড়িটা কিনে।’

‘আরে কি বলেন? কচি কলাপাতা রঙ আমার খুব পছন্দ। তার ওপর গোলাপি পাড়, আচঁল হলে তো সোনায় সোহাগা!’ বলেই বাধঁন মিটমিট করে হাসলো। বলল, ’তাহলে না হয় কচি কলাপাতা রংয়ের শাড়িটা পেলাম। কিন্তু ওটা তো বস্তু। প্রশ্নটা হচ্ছে আমার মূল্য নিয়ে, মানুষের মূল্য নিয়ে। মানুষের মূল্য তাহলে কিভাবে নির্ধারণ করবেন?’

‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে চাচ্ছি, প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট মূল্য আছে!’ বলেই অংশু বাধঁন এর মুখের দিকে তাকালো।

বাধঁনের মুখটা বেশ শুকিয়ে গেল। এতক্ষণ সে যেভাবে অংশুর দিকে তাকিয়ে ছিল সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ব্যাগের ফিতা আঙ্গুল দিয়ে খুঁটতে লাগলো। অংশু ক্ষণিকের জন্যে চুপ হয়ে গেল। নিঃসঙ্গতা ভেঙ্গে বাধঁন বলল, ‘কি থেমে গেলেন যে?’

‘হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষের মূল্য আলাদা। তোমাকে একটি উদাহরণ দেই। ধরো, তুমি তোমাদের বাড়িতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। দ্বিতীয়তঃ উপজেলা চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। তৃতীয়তঃ তুমি একজন সংসদ সদস্যকে দাওয়াত দিলে। চতুর্থতঃ তুমি একজন মন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। পঞ্চমত তুমি প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। এই দাওয়াতগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে তুমি কিন্ত একই রকম আয়োজন করবে না।’

বাধঁন টু শব্দও করছে না, যেন গোগ্রাসে অংশুর কথা খাচ্ছে।

অংশু আবার শুরু করল, ’তুমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জন্য যে আপ্যায়ন করবে, উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য তার চেয়ে ভালো আয়োজন করবে। আবার উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অনেক বেশি আয়োজন করবে। কারণ, তুমি জানো যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ঘরে দাওয়াত করে আনার যে পরিমাণ মূল্য বা উপযোগিতা তা সাময়িক। তার তুলনায় উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বেশি অনুভূত মূল্য পাবে। সংসদ সদস্য হলে আরও বেশি, মন্ত্রী হলে তার চেয়ে বেশি, প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক বেশি অনুভূত উপযোগিতা পাবে।’

‘আমি জানি আমি কোনো চেয়ারম্যান বা এমপি নই। কিন্তু তাই বলে আমার মূল্য ৫ টাকা কিভাবে হলো? আজকাল ৫ টাকায় একটা দিয়াশলাইও পাওয়া যায় না।’

মনে হলো বাধঁন বেশ রাগতস্বরেই প্রতিবাদ করলো। অংশু জিজ্ঞেস করলো, ‘৫ টাকার কথা আসছে কেন?’

‘আমাকে একজন বলেছে যে আমার মূল্য নাকি ৫ টাকা।’

‘হ্যাঁ, সেটা জানি যে তুমি চেয়ারম্যান বা এমপি নও। তবে তোমাকে কি ধরনের মানুষের সাথে তুলনা করব, তুলনা করা আদৌ ঠিক হবে কিনা তাই ভাবছি।’

‘আপনি যা খুশি তার সাথে তুলনা করতে পারেন, আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি আমি কি ধরনের মেয়ের সাথে তুলনীয়।’

‘হাত নাড়িয়ে অংশু বাধঁনকে থামানোর ভঙ্গিতে বলল, আমি আসলে তোমাকে কিছুর সাথে তুলনা করতে চাইনি।’

‘না ঠিক আছে’, বলে মাথা নাড়িয়ে বাধঁন সায় দিল।

এবার একটু রসিকতার ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখে অংশু বাধঁনকে বলল, ’তুমি কি জানো বিভিন্ন দিয়াশলাইয়ের দাম বিভিন্নরকম হয়?’

‘তাই?’, বাধঁন বিস্ময় প্রকাশ করে।

‘হ্যাঁ, তাই। জানো কোনো কোনো দিয়াশলাই দিগুণ দামেও বিক্রি হয়।’

’কিভাবে?’

‘এই যেমন এক রকম দিয়াশলাই কাগজের, কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো। কাগজের ওই খাপের মধ্যে বাতাস বা জলীয়বাস্প ঢুকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি উদায়ে যায়। অনেক বার দিয়াশলাইয়ের গায়ে কাঠি ঘষলেও আগুন জ্বলে না।’

‘আপনি সিগারেট খান?’

‘হঠাৎ এ রকম অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছো কেন?’

‘দিয়াশলাই জ্বালাতে আপনার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না’, বলেই হা হা কোরে হেসে উঠলো বাঁধন।

‘হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে মন উদাস হলে তখন খাই’

‘মন উদাস কমে সিগারেট খেলে?’

‘না। সিগারেট খাওয়া খারাপ— এটা মনে হলে মন আরও উদাস হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর সিগারেট খাব না, মায়ের বাধ্য ছেলের মত হয়ে যাব। সবাই আমাকে পছন্দ করবে। বলবে, অংশুর মতো অমায়িক ছেলে হয় না। এমনকি বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত খায় না।’

‘বাধ্য ছেলেদের সবাই পছন্দ করে— এই কথাটি ঠিক না। মায়ের বাধ্য ছেলে, তার বউয়ের কাছে ভালো না’, বাধঁন প্রতিবাদ করল।

‘হুম, বুঝলাম না’, বলেই অংশু অন্যমনস্ক হলো ক্ষণিকের জন্য।

বাঁধন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা বলুন।’

সম্বিত ফিরে পেলো অংশু বাধঁনের আবদার মেশানো প্রশ্নে।

‘দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা বলতে বলতে থামলেন কেন?’

‘ও হ্যাঁ, মনে করো যদি কাগজের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাই, যার গায়ে দিয়াশলাইয়ের বারুদ লাগানো কাঠি দিয়ে ঘষলেও আগুন জ্বললো না। আবার প্রায় কাগজের মতো পাতলা করে কাটা শিমুল গাছের কাঠ দিয়ে বানানো দিয়াশলাই যা জলীয় বাষ্প রোধ করে। এরকম কাঠের দিয়াশলাইয়ের মধ্যে রাখা বারুদ মাখানো কাঠের কাঠি দিয়ে বাক্সের গায়ে ঘষা দিলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাঠিতে আগুন জ্বলে উঠলো। এক্ষেত্রে কাঠের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাইয়ের মূল্য কাগজের খাপের দিয়াশলাইয়ের তুলনায় বেশি হবে।’

‘এই তুলনা করাটাই আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়।’

অংশু ভয়ে ভয়ে বাঁধনের দিকে তাকালো। ভাবল, এই বোধহয় একটা ঝামেলা বেধে গেলো। চুপ হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্ত।

বাঁধন বলল, ‘আমি কখনো সজীবকে কারো সাথে তুলনা করিনি। সজীব ওর বিয়ের পর থেকেই আমাকে সবসময় তুলনা করে। কিন্তু আমার কাছে ও তো অমূল্য। ওকে যে আমি অনেক লভ করি।’

আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রকৃত ভালোবাসাকে ‘লভ’ বলে। লভ শব্দটা টেনে একটু লম্বা করে বলে, ইংরেজি শব্দ লাভ আরকি। যার মানে ‘ভালোবাসা’ সেটার গভীরতম একটা অবস্থা। এসব বিষয়গুলো অংশু খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে, কারণ বাহ্যিকভাবে ভালোবাসা, প্রেম, লভ, লাভ, ইত্যাদির মানে একই হলেও ইদানিং প্রকৃতভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণভঙ্গির উপর নির্ভর করে শব্দটির মানে ও গভীরতা। অংশু ভাবে শেক্সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথের সময়ে এই শব্দার্থের পার্থক্য হলে নিশ্চয়ই তারা কবিতার ছন্দে শব্দগুলোর মর্মার্থ বুঝিয়ে দিতেন।

‘বিয়ের পর থেকে, মানে কি?’ অংশু যেন আকাশ থেকে পড়ল। বাধঁন চোখ নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে হাতেপরা স্বর্ণের ব্রেসলেটটি নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছে।

অংশু আবার কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি বিয়ে করেছ?’

‘আরে না, ও আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল।’

অংশু কি বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। বাধঁনের সাথে প্রায় বছর খানেক মাঝে মধ্যেই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা মেরেছে, কিন্তু এরকম একটা বিষয় কখনো সে আকার-ইঙ্গিতেও বলেনি। অবশ্য কারো মুখ দেখে তার ভেতরে কি হচ্ছে বোঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অপারগ হয়ে অংশু ’বাধঁন, তুমি একটু ঝেড়ে না কাশলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’ বলেই চুপ হয়ে গেল। কেউ একটা কথাও বলছে না। বাধঁন মাথা ঝুকিয়ে হাতের উপর থুতনি ঠেশ দিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। অংশু বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, বাধঁনের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তি অংশুকে স্পর্শ করছে বলে মনে হচ্ছে। এই বিরক্তি যে কিসে তা অংশু নিজেও বুঝতে পারল না। বিরক্তিটা এতক্ষণ বকবক করার জন্য নাকি বাধঁনের বিষয়টা এতদিন বুঝতে না পারার জন্য?

বাধঁন মাথা তুললো। বলতে শুরু করল, ‘আমার সাথে সজীবের পরিচয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের যারা শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী তাদের একটি গ্রুপ আছে। মাঝেমধ্যেই আমাদের চ্যাটিং রুমে কথোপকথন হতো, আলোচনা হতো। সেই গ্রুপে সজীবও একজন সদস্য ছিল। আলাদাভাবে আমি সজীবকে কোনো কথা লেখার বা বলার প্রয়োজন অনুভব করিনি। যেহেতু সবাই সংস্কৃতিমনা তাই বিভিন্ন কবিতার বই, উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হলিউড, বলিউড, বাংলা সিনেমা— এসব নিয়ে কথোপকথন হতো।

‘সজীব কি তোমার একই বয়সী?’, বলেই অংশু চুপ করে বাধঁনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘না, ও আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। অন্য বিভাগে পড়তো।’ বাধঁন আবার বলতে শুরু করলো, ‘এভাবে বেশ কিছুদিন ফেসবুকে কথোপকথন হওয়ার পর সজীব আমাকে একদিন সরাসরি ফেসবুকে মেসেজ করল, প্রাইভেটলি। কয়েকদিন পর আমি জবাব দিলাম। এভাবে আবার বেশ কিছুদিন চলল। ছেলেটাকে আমারও বেশ ভালো লাগতে শুরু করল একজন বন্ধু হিসেবে। হঠাৎ করেই একদিন ও আমাকে কফি খাওয়ার দওয়াত করলো। আমরা বনানীর একটি কফি হাউসে দেখা করলাম। অনেক কথা হলো, হাসি-ঠাট্টার মাঝে আমাদের প্রথম সামনাসামনি সাক্ষাৎ শেষ হলো। কিন্তু তার রেশ রয়ে গেলো আমার মাঝে। মনে হচ্ছিল আমি কি এতদিন এমনি কারো অপেক্ষাতে ছিলাম?’

‘তাই কি? এরকম কাউকে কি তুমি মনে মনে কল্পনা করতে?’, অংশু সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করলো।

‘না, তা ঠিক না।’

‘তাহলে?’

‘আমার লম্বা, ফর্সা ছেলেদেরকে ভালো লাগে। তবে লম্বা ভুড়িওয়ালা লম্বা ছেলে না।‘, বলে একটু মুচকি হাসলো।

‘সজীব লম্বা হলেও গায়ের রঙ বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড রঙের চেয়ে একটু চাপা। কিন্তু শ্যামলা মুখে হাসলে ওকে দারুণ স্মার্ট ও চকচকে মনে হয়। মাথায় কোকড়া চুল সুন্দর করে কাটা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাত দিয়ে দাঁড়িগুলো নাড়তে নাড়তে ও যখন কথা বলে, আমার মুখে সুড়সুড়ির মতো একটা কিছু অনুভূতি হতো।’

‘তার মানে তুমি তখন তার মুখে হাত বুলিয়েছ?’
‘না, না, কি বলেন?’ বলেই লাজুক ভঙ্গিতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। এরপর আবার কথা বলা শুরু করলো, ‘এভাবেই আমাদের প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনসহ সপ্তাহে দু-তিন দিন দেখা হতো। কখনো চায়ের দোকানে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তারপর মনের অজান্তেই একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছি।’

‘কে প্রথম প্রেমে পড়লো?’

‘সজীবই প্রথম আমাকে প্রস্তাব দেয়। যদিও আমরা দুজনই জানতাম যে এখানে প্রত্যাখ্যানের আর কোনো অবকাশ নেই।’

অংশু মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁধনের মিষ্টি প্রেমের কথা শুনছিল। মনের অজান্তেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাহ, সুন্দর একটা তারুণ্যের আর প্রেমের উপখ্যান শুনছি।’ বলেই আরো শোনার আশায় চুপ করে গেল।

‘হ্যাঁ, এভাবে নয় মাস চলল। তারপর একবার আমার বাড়ির সবাই কোনো এক কাজে গ্রামের বাড়িতে গেলে আমি সজীবকে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসতে বলি। আমরা দুজন ভীষণ ভয়ে ভয়ে একে অন্যের সাথে একান্তে দেখা করি। এরকম একটু সুযোগ পেলেই সজীব আর আমি আমাদের বাড়িতে দেখা করতাম। ক্রমাগতভাবে আমরা অনেক ঘনিষ্ট হলাম।’

একটু থামলো বাধঁন, যেন কোনো এক জড়তা তাকে গ্রাস করতে আসছে। অংশু কোনো কথা বললো না। যতটুকু তার বোধগম্য হলো তা বুঝে নিল।

বাধঁন বলতে থাকল, ‘তারপর সজীব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হলো ও একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি পেল। চাকরির সুবাদে ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলো। আমার সবকিছু কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। এরপর থেকে শুধু ছুটির দিনে ও ঢাকা আসতো। ঢাকা এলেই আমরা দুজনে রেস্টুরেন্টে খেতাম, কফি হাউসে কফি খেতাম, অনেক কথা অনেক গল্প করতাম, খুনসুটি করতাম। অকারণে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতাম। ওর যেহেতু আর কোথাও থাকার ব্যবস্থা ছিল না, তাই আমরা এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে একান্ত সময় কাটাতাম।’

এভাবে আমাদের অনেক ভালবাসা আর আনন্দে আরো বছর খানেক কাটলো।

‘তাহলে সমস্যাটা হলো কোথায়? সবই তো ঠিক আছে বা ছিল’, অংশু ফোড়ন কাটলো।

‘একদিন আমি সজীবকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। কয়েক মিনিট পরে আবার ফোন করলাম। এবার দুটো রিং হওয়ার পর একজন মহিলার গলা শুনলাম।’

‘হ্যাঁলো কে বলছেন? আমি একটু ভড়কে গেলাম। বললাম, আমি বাধঁন, সজীবের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বলেই আমি ইতস্তত করলাম।’

‘বাধঁন? বাঁধন নামে কোনো বান্ধবীর কথাতো সজীব কখনও বলেনি। আমি সজীবের মা। কিছু বলতে হবে?’ রাগতঃস্বরে সজীবের মা বললেন।

‘সজীবের সাথে একটু দরকার ছিল।’

‘সজীব এখন গোসল করছে। বাথরুম থেকে বের হলে তোমার কথা বলবো। বলেই সজীবের মা ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন।’

‘তারপর?’ অংশু বাধঁনকে জিজ্ঞেস করলো।

‘সজীব পরেরদিন কল ব্যাক করলো। অনেক রাগারাগি, তারপর গালিগালাজ করলো।’ খুব মন খারাপের স্বরে বাঁধন বলে চলল, ‘কেন ফোন করেছিলাম, মা যখন ফোন তুললো তখন লাইন কেটে দিলাম না কেন বলে চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো। ওইদিন আমি অনেক কাঁদলাম। রাতে মনটা আর মানছিল না। আমি আবার ফোন করলাম, কিন্তু সজীব আমাকে ফোনে, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে— সব জায়গায় ব্লক করে দিয়েছে। এভাবে প্রতিদিন সজীবকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করতাম। সপ্তাখানেক পরে ও আমাকে ফোন করে আবার অনেক বকাঝকা করলো। আর যেন কখনো ফোন না করি তাই বলে শাঁসালো। তারপর ছয় মাস আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। এই ছয় মাসে ওর মা ওকে বিয়ে দিয়েছে। আর ও সেটা মেনে নিয়ে বিয়ে করেছে। আর ওই বিয়েটা একুশ দিন টিকেছে।’

‘তুমি কিভাবে জানলে?’ অংশু বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো।

‘একদিন একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। আমি ভাবলাম কে না কে, তাই ফোন ধরিনি। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন এলো। কৌতূহলবশতঃ ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে সজীব ফোন করেছে। সে জেলখানার অফিসের ফোন থেকে কথা বলছে। আমাকে খুব অনুনয় করে বললো যে সে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে অনুমতি পেয়েছে ফোন করার জন্য। আমি যেন লাইন কেটে না দেই।’

‘জেল থেকে ফোন করেছ কেন?’

‘কারণ, সজীব তখন জেল খাটছে।’

‘মানে কি?’, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অংশু প্রশ্ন করলো। তার কাছে সবই যেন অবিশ্বাস্য, বানানো একটি গল্পের প্লট মনে হলো। এত সব ব্যাপার অংশুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

নীরবতা ভেঙ্গে গ্লাসের মধ্যে পানি নাড়তে নাড়তে বাধঁন বললো, ‘সজীবের নতুন বউ একুশ দিনের মাথায় বাপের বাড়ি চলে গেছে। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মামলা করেছে থানায়। আর ১০ লাখ টাকা দাবি করছে ক্ষতিপূরণ বাবদ।’

অংশু নড়েচড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মুহূর্তে তার নিজের বিয়ে করার ইচ্ছা বা শেরওয়ানি, পাগড়ি ইত্যাদি কেনার আকাঙ্ক্ষা এক্কেবারে গরম কড়াইয়ে এক ফোটা পানির মত ফুস্ করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিজের কানকেও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তারপরও বাঁধনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?’

‘না, মামলা চলছে। তিন মাস জেল খেটে সজীব জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে।’

‘সেই বউয়ের কোনো পরিচয়, নাম-ধাম তুমি জানো?’

‘না। তবে শুনেছি সেই মেয়েটা আমার থেকে লম্বা ছিল। মালয়েশিয়া থেকে কি যেন একটা ডিপ্লোমা করে এসেছে ম্যাসাজ থেরাপির ওপর।’

‘ইন্টারেস্টিং’, বলেই অংশু ঠোট বাঁকা করে চোখ বন্ধ করে মাথাটা ডানে-বায়েঁ ঝাঁকালো।

‘ইন্টারেষ্টিং কেন?’

‘দ্যাখো, এক বিংশ শতকের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সময়ে একটা চাকরিজীবী যুবককে মা বিয়ে ধরে বেঁধে দিয়ে দিলো। আর সেও চোখ বুঁজে নিরুপায় হয়ে নিঃশব্দে বিয়ে করে ফেলল। কেন জানি এটা ঠিক মিলছে না।’

‘আমাকে সজীব তাই বলেছে।’

‘আমাদের সমাজে ঘটা করে একটা বিয়েতে অনেক পরিকল্পনা, আয়োজন, বিয়ের চিঠি ছাপানোর থেকে শুরু করে ফুলের মালা, গায়ে হলুদ, বরযাত্রীদের যানবাহন, বউভাত ইত্যাদি অনেক বিষয় জড়িত। এখানে বিষয়টা ঝপ করে ব্যাঙ ধরার মতো হয়নি। সজীব আর কি কি বলেছে তোমাকে?’

‘বলেছে সে আমার সাথে ফিরে আসতে চায়, আমাকেই সে বিয়ে করবে।’

‘বাঃ বাঃ বাঃ। সে তো সেটা চাইবেই। কিন্তু বিষয়টা ওর বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল না?’

‘সে হোক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’

‘ওদের ডির্ভোসের দরখাস্ত বা মামলার দরখাস্ত কখনো দেখেছ?’

মাথা নাড়িয়ে বাধঁন ‘না’ সূচক জবাব দিলো।

‘তাহলে তুমি কি ওর সাথে দেখা করো?’

‘হ্যাঁ, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রায়ই দেখা করতে আসতো। মামলা শেষ হলেই ও আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।’

‘সেটা কতদিন লাগবে?’

‘তা তো জানি না। বলেছে শিগগিরই হবে। তাও প্রায় দেড়বছর হয়ে গেল। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে সজীব খুব রেগে যায় আর খুব খারাপ ব্যবহার করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।’

‘শেষ কবে দেখা হয়েছিল?’

‘এক মাস আগে। তারপর আমাকে ব্লক করে রেখেছে। তারপরও আমি ওকে প্রতিদিন ফোন করার চেষ্টা করি। সেদিন হঠাৎ ওকে ফোনে পেয়েছিলাম।’

‘কি কথা হলো?’

‘আমাকে অনেক গালিগালাজ করলো। ওকে ফোন করতে নিষেধ করলো। আর বললো, আমার মূল্য তার কাছে ৫ টাকার সমান।’

অংশু খানিক চিন্তা করলো। সে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে আছে মনে হলো। ভ্রু কুঁচকে আবার ঘূর্ণীয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার মাথার মাঝে অনেক পাজল বা ধাঁধা ছুটে লাফিয়ে ভিডিও গেমের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলো। প্রতিটা পাজল খণ্ড তার আকৃতির বা ডিজাইনের সাথে মেলে এরকম আর একটা ডিজাইনকে খুঁজছে। একটা খণ্ডের সাথে আরেক খণ্ডের মিল নেই। কিন্তু তারা তাদের সাথে খাপ খায় এরকম অন্য খণ্ড খুঁজছে। যদি না মেলে, তবে একে অন্যকে চুম্বকের বিকর্ষণের মতো এক খণ্ড অন্য খণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিপরীত দিকে সরে যাচ্ছে। অংশু যখন প্রাত্যাহিক জীবনের বিষয়গুলোর জটলা ছাড়াতে পারে না, তখন তার মাথার মধ্যে এরকম হয়। মাথার মধ্যে অনেক রং বেরঙের আকৃতি, নম্বর, ইত্যাদি উড়ে বেড়ায়। এসব আকৃতি উড়ে বেড়ানোর সময় যদি একটা আকৃতি আর একটার সাথে ঠোকর খায়, তবে সে ভিডিও গেমের মতো ‘টিটিং’ একটা শব্দ মাথার মাঝে অনুভব করে বা শুনতে পায়।

অনেক দিন আগে অংশু একবার তার মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়া অত্যধিক স্মার্ট একটা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল তার এই বিষয়টা কেন হয়। বন্ধুটি বলেছিল যে এই বিষয়টা মানুষের অবচেতন মনের একটি অধ্যায়। যেখানে সে জেগেই তন্দ্রার মাঝে চলে যায়। এর নাম সাইনেসথেসিস। সাইনেসথেসিস হলো মানুষের একটি অবচেতন মনের ক্ষমতা বা অবস্থা যখন সে স্বাদ, গন্ধ, দৃশ্যমান রঙিন ইত্যাদি মিশ্রিত করে অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে ও অনুভব করে। বন্ধুটি আরো বলেছিল যে পৃথিবীর প্রায় ৭ শতাংশ মানুষের এমন ক্ষমতা থাকে। অংশুর মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে যে এটা কি ক্ষমতা নাকি অক্ষমতা কে যানে? সমাজে সাধারণ কে সাধারণ দেখতে না পারা এক ধরনের অক্ষমতা বৈকি।

‘হ্যালো, আছেন?’

মুখের সামনে বাঁধনের হাত নাড়ানো আর ডাক শুনে অংশুর মাথার মধ্যের ডিজাইন আর রং বেরংয়ের নকশাগুলি মুহূর্তে পালিয়ে গেল।

‘ও হ্যাঁ, আছি’। বলে মুচকি হাস হেসে বলল, ‘হ্যাঁ শুনছি বল।’

বলেই অংশু বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

‘আমি বলছি না তো! আরে আমি শুনছিলাম। আমার মূল্য ৫ টাকা কিভাবে হল সেইটা বলছিলেন।’

‘Oh yes, that’s right.’

বাধঁন লক্ষ্য করেছে অংশু সিরিয়াস কিছু বললে ঠুস্ ঠাস্ আমেরিকানদের মত করে ইংরেজি বলে। বাঙালিরা সাধারণতঃ ব্রিটিশ ইংরেজি শুনতে অভ্যস্ত। অংশু বিষয়টা সামলে নিয়ে বলে, ‘তোমাকে একটা দিক বলা হয়নি। কারণ, ওই দিকটি আমি জানতাম না। এই মাত্র জানলাম।’

বিস্ময়ে বাধঁন জিজ্ঞেস করে, ‘কোন দিকটি?’

‘ক্রেতা বা দামদরকারীর দিকটি। এখানে সজীব হল দামদরকারী। দেখো, পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের একটি মূল্য আছে। সেই মূল্য স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আগেও বলেছি তোমাকে। তবে দামদরকারী ও জিনিস এ দুটোরই গুরুত্ব আছে। কারো গুরুত্ব কম বা বেশি নয়।’

‘কিরকম?’

‘জিনিসের যেমন উপযোগিতা আছে, তেমনি জিনিসের দামকারীরও যোগ্যতার বিচার আছে। এই যোগ্যতা হলো শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান, আর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা আর্থিক ক্ষমতা।’

‘সজীব তো এখন বেশ আয় করে, তাহলে তার ক্রয়ক্ষমতা কি মাত্র ৫ টাকা?’ অভিযোগের সুরে বাধঁন অংশুকে প্রশ্ন করে।

‘বিষয়টার সে রকম না।’

‘তাহলে কি?’

‘বিষয়টা বলতে একটু দ্বিধা হচ্ছে।’

‘আচ্ছা বাবা, বলুন তো। আমি কিছু মনে করবো না।’

অংশু সোজা হয়ে বসলো। ঘাড় সোজা করে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, ‘জানো, আমেরিকানদের মধ্যে একটি প্রচলিত উক্তি আছে- Someone’s trash is someone else’s treasure’ অর্থাৎ, এক ব্যক্তির কাছে যা অকেজো, মূল্যহীন তা অন্যের কাছে মূল্যবান।’

‘অনুবাদ করতে হবে না বুঝতে পেরেছি।’

‘আবার এমন ও হতে পারে যে তুমি বেশ সহজলভ্য। এখানে তোমার মুল্য ও সজীবের sacrifice ৫ টাকার সমতুল্য। সেক্ষেত্রে ৫ টাকার সমান অর্ঘ্য বা স্যাক্রিফাইসে তোমাকে কেনা বা পাওয়া যাবে, বলেই বিষয়টাকে হালকা করার জন্যে অংশু হেসে ফেলল।

‘কি বলেন? ৫ টাকা কোনো অর্ঘ্য হল? আজকাল মানুষ ভিখারিকেও ৫ টাকার বেশি ভিক্ষা দেয়’, বলেই রেগে এদিক ওদিক তাকালো।

‘আচ্ছা বিষয়টা তাহলে অন্যভাবে বলি। Say for example, if we turn the table, আমরা যদি টেবিলটা ঘুরিয়ে দেই তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াবে?’

‘মানে কি?’

‘মানে হলো, মনে করো, তোমার জায়গায় সজীব আর সজীবের জায়গায় তোমাকে বসালে কেমন হবে?’

‘কিন্তু আমি তো ওকে অনেক লভ করি। ও তো আমার এই পরিমাণ লভ কখনই করতে পারবে না।’

বাঁধন অবুঝের মত বাধ সাধলো। অংশু বিষয়টা কিভাবে এই অসীম প্রেমে পড়া মেয়েটাকে বোঝাবে তার কূলকিনারা পেল না। তবুও বলল, ‘আচ্ছা, তোমার কথা বাদ দিলাম। মনে করো, একটি শিক্ষিত সাধারণের চেয়ে সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়ে তোমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। তোমার এই বেস্টির কাছে একটা ছেলে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এলো। ছেলেটা একবার বিয়ে করেছিল অন্য একটি অবিবাহিত মেয়েকে। আপাততঃ ছাড়াছাড়ি হয়েছে। সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক ওই স্ত্রী শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ করেছিল তার স্বামীর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ছেলেটার জেল হয়েছিল। এখন জামিনে মুক্ত আছে। তবে যখন তখন সে খোয়াড়ে ঢুকে যেতে পারে। ছেলেটার তেমন অর্থবিত্তও নেই। তোমার বান্ধবী ছেলেটাকে কি বলবে? প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করবে নাকি প্রত্যাখ্যান করবে? মেয়েটার কাছে ওই জেল ফেরত ছেলেটার এক্সচেঞ্জ ভ্যালু বা বিনিময় মূল্য কত? সোজা কথায়, ওই অবিবাহিতা সুন্দরী বান্ধবীর কাছে ওই বিবাহিত জেল ফেরত বিচারাধীন ছেলেটির মূল্য কত?’

‘দ্যাখেন জেল ফেরা সব আসামিরাই খারাপ না’, বলেই বাধঁন খুব গম্ভীর হয়ে গেল ওর মুখ চোখের উপর একটা মেঘলা ছাঁয়া ছাপিয়ে গেল। আবার বলল, ’প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যায় না।’

‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি অনেক সিরিয়াস দাগী আসামিদেরও অনেক মেয়ে ভক্ত থাকে’, বলেই অংশু হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো।

বাধঁন বেশ রাগতস্বরেই অংশুকে বলল, ‘দেখেন, এভাবে আমাকে নিয়ে তামাশা করে হাসবেন না’, বলেই স্যান্ডেল খুললো। বাঁধন টেবিলের উপরে একটু ঝুঁকল। অংশু বেশ ভয় পেয়ে গেল। আজকালকার মেয়েদের কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। ভাবলো, স্যান্ডেল হাতে উঠালেই ঝেড়ে দৌড় মারবে। পেছনে তাকাবে না। বিপদ বলে কয়ে আসে না। বাঁধন ডান পাটা বাম হাঁটুর উপরে উঠিয়ে জোরে জোরে পায়ের তলা চুলকালো। বলল, ‘আমাকে নিয়ে কেউ হাসি তামাশা করলে আমার পায়ের তলা চুলকায়।’

অংশু অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে হাত দুটি গুটিয়ে বসে থাকল। ভাবলো মেয়েটিকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া প্রয়োজন। তাই গম্ভীর গলায় বলল, ‘একজন ব্যক্তির মূল্য আর্থিক বা মুদ্রা বিষয়ক বা অন্য কোনো পরিমাণগত ইউনিটে পরিমাপ করা যায় না। প্রতিটি ব্যক্তি অনন্য এবং তাদের মূল্য অপরিমেয়। মানুষের সহজাত মর্যাদা এবং মূল্য আছে কেবল মানুষ হওয়ার কারণে।’

বাধঁন এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে টালুমালু হয়ে তাকালো। বাতাসের মাঝে তাকে কোন ছকে ফেলা যায় তার অনুধাবন করার চেষ্টা করলো। নিজেকে জগতের কোনো ছকে ফেলা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। সে তার ছক খুঁজে পেলো কিনা বোঝা গেল না। যখন তার চোখ অংশুর দিকে ফিরে এলো, অংশু আবার বলতে শুরু করলো, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির তার প্রতিভা, দক্ষতা এবং ক্ষমতার মাধ্যমে তার নিজস্ব উপায়ে বিশ্বে কিংবা মহাজগতে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির ভালোবাসার, তৈরি করার, শেখার, বেড়ে ওঠার এবং তাদের চারপাশের লোকদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতাও রয়েছে।’

‘অতএব, একজন ব্যক্তির মূল্য অপরিমেয় এবং কোনো বাহ্যিক কারণ, যেমন তার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান, বা শারীরিক চেহারা দ্বারা তার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। প্রতিটি ব্যক্তিই মূল্যবান এবং কেবল পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের কারনেই সে সম্মান এবং মর্যাদার যোগ্য।’

‘এটা তো রাজনীতিবিদদের মতো কথা বললেন।’

অংশু ছদ্ম গাম্ভীর্যে ইতস্ততঃ করে বলল, ‘বিষয়টা সে রকম নয়, তবে যা বললাম ওটা সর্বজনীন। আর যদি নির্দিষ্ট করে তোমার কথা বলতে হয়, তাহলে তোমার কাছেও সজীবের মূল্য এক জায়গায় স্থির থাকবে না। সময়ের সাথে উঠা নামা করবে। ওই যে মনে আছে তোমাকে দিয়াশলাইয়ের উপমাটা বলেছিলাম? আমার মনে হয় তোমাদের সম্পর্কের স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গের মাত্রা কমেছে। ফলে সম্পর্কের মূল্য কমে এসেছে, মানুষের মূল্য নয়।’

এই যে জীবনের এক্সচেঞ্জ ভ্যালু আর ক্রেতা বা দামদরকারীর স্থান নিয়ে বাধঁন যেন হতবিহবল। হাত ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাধঁন উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘চলুন উঠি, বড্ড গরম পড়েছে।’

‘চলো, তোমাকে রিকশা ডেকে দি’, বলেই অংশু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

অংশু উঠে দাঁড়ানোর সময় লক্ষ্য করল, বাঁধনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে চক্ চক্ করছে। আর একটু দেরি হলে হয়তো টপ্ টপ্ করে কপাল বেয়ে মাটিতে পড়বে।

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক, বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর