ডায়মন্ডের পাথরকে আমার কাছে বরাবরই আপেক্ষিক মনে হয়। অনেকটা বিশ্বাসের মতো। স্বীকার করলে ডায়মন্ড, অস্বীকার করলে একটি পাথর মাত্র।
২০০৮ সাল। কানাডার ক্যালগেরির মাউন্ট রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করি একটি ডায়মন্ডের দোকানে— ‘পিপলস দ্যা ডায়মন্ড’ স্টোরে।
বিজ্ঞাপন
ডায়মন্ডের সাথে স্টোরটিতে স্বর্ণ ও ঘড়িসহ বিভিন্ন ধরনের আইটেম বিক্রি হয়। দোকানটিতে কাজ করলেও প্রথম প্রথম ডায়মন্ড বিক্রি করার অনুমতি ছিল না আমার। ডায়মন্ড বিক্রি করতে গেলে ডায়মন্ডের বিষয়ে সার্টিফিকেট বা লাইসেন্স লাগবে। তবেই ডায়মন্ড বিক্রি করতে পারব। বলা বাহুল্য, কানাডায় ভালো কিছু করতে গেলে সেই বিষয়ে সার্টিফিকেট বা লাইসেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়।
একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া অন্যদিকে চাকরির জন্য লেখাপড়া— সবমিলিয়ে কঠিন একটা সময় পার করলেও হাল ছাড়িনি। এখানে চাকরির সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। পুরো সামারে ফুলটাইম করে কাজ করতাম। আবার নিজের জন্য কিছু কিনতে গেলে ৩০% ডিসকাউন্টও পেতাম। যাই হোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ডায়মন্ডের ওপরে সার্টিফিকেট নিলাম। হয়ে গেলাম ‘সার্টিফাইড ডায়মন্ড সেলার’। তখন ডায়মন্ড বিক্রি করা শুরু করলাম।
বাংলাদেশের স্বর্ণকারদের মতো একটা চশমা সবসময় গলায় ঝুঁলিয়ে রাখতাম। ক্রেতারা যখন কিনতে আসতো, দামদার ঠিক হয়ে গেলে চশমা পরে ডায়মন্ড ভালো করে দেখে পরীক্ষা করে বিক্রি করতাম। ডায়মন্ডের মধ্যে দামের সামঞ্জস্য রেখে আবার প্রকারভেদও রয়েছে। স্টোরটিতে ১৫ থেকে ৬৫ বয়সের মেয়েরাই বেশি আসতো। সে এক অন্য রকমের অভিজ্ঞতা ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়ার পর কানাডার ব্যাংকে ফুলটাইম জব শুরু করলাম। পাশাপাশি পার্টটাইম ডায়মন্ডের দোকানের কাজটা ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সাংবাদিকতায় সময় দিতে গিয়ে ডায়মন্ড স্টোরের কাজটি আর ধরে রাখতে পারিনি।
বিজ্ঞাপন
আব্বা-আম্মা বেঁচে থাকতে প্রতি বছরই বাংলাদেশে যেতাম। একবার ঢাকায় এক ভাবীকে দেখলাম গুলশান থেকে ডায়মন্ডের রিং কিনে খুব এক্সাইটেড। আমাকে দেখানোর পর বলে দিলাম এটা কি ধরনের ডায়মন্ড। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ভাবছিলেন, কি করে এত সঠিক বর্ণনা দিলাম! তখনও উনি জানতেন না যে, আমি ডায়মন্ডের ওপরে লাইসেন্স হোল্ডার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমিও কিছুটা অবাক হয়েছিলাম এত পুঙ্খানুপুঙ্খ মিলে যাওয়ায়।
সেদিন বন্ধু তালিকায় এক পুরানো বন্ধুকে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, যারা আমার তালিকায় রয়েছে তাদের অনেকেই এই পূথিবীতে নেই। খুব অবাক বিস্ময়ে তাদের আইডি দেখছিলাম। মানুষের জীবনে অনেক বড় ব্যাপার হলো শেষ দেখা। কত পরিচিতজনদের বলে এসেছি, আবার দেখা হবে। আসলে কি তাই? আর এই জীবনটাই একটা খেলাঘর। বসে বসে কত কথা ভাবছি। অথচ আমরা যে যাই করি না কেন, উপর ওয়ালার ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা। বুঝে যতই না বোঝার ভান করি না কেন!
মা-বাবা আজ বেঁচে নেই। এ সংসারের নিত্য খেলায়, প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়, এই প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ মানুষ দুটি আর হেঁটে-চলে বেড়াবেন না! মানুষের বেঁচে থাকা তো আসলে অন্যের মনে ও মননে। যে আসলে জীবনে মানুষের মতো বেঁচে থাকে, তার দৈহিক প্রাণের স্পন্দন থেমে গেলেও আসল প্রাণ সর্বদাই জীবিত।
প্রতি বছরই এই দিন ফিরে আসবে কিন্তু যাদের বদৌলতে পৃথিবীতে আসলাম তারা আর ফিরে আসবে না। তাদের প্রতিটি স্পন্দন আমাকে স্পর্শ করে, তাদের স্নেহ-ভালবাসা আমাকে আবেগে তাড়িত করে। রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বি ইয়ানি সাগিরা। তাদের প্রতিটি দোয়া আমার জীবনের পাথেয় হয়ে রয়েছে। শুধু আফসোস, ডায়মন্ডের মতো, যদি সবকিছুই চিনতে পারতাম!
লেখক: আহসান রাজীব বুলবুল, সাংবাদিক ও প্রধান সম্পাদক, প্রবাস বাংলা ভয়েস, কানাডা।

