আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে দল ভেঙে দেওয়া বা নিজ দল ছেড়ে বড় দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক রাজনৈতিক নেতাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ নজর কেড়েছে।
নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এসব নেতার বড় দলে যোগ দেওয়া এবং সেখানে যোগ দিয়েই সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়াকে অনেকেই ‘এমপি হওয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা’ হিসেবে দেখছেন। সমালোচকদের মতে, ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকতে নীতি ও আদর্শকে পাশে সরিয়ে রাখার প্রবণতা এবার আরও প্রকাশ্যে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—নির্বাচনকে সামনে রেখে আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ‘যে কোনো মূল্যে এমপি হওয়া’র এই প্রকাশ্য চেষ্টা কতটা নৈতিক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংসদের সদস্য হওয়া মানেই ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ফলে এমপি পদকে ঘিরে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যে কোনো উপায়ে নির্বাচিত হওয়ার একটি প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা কাজ করে।
তবে ভিন্নমতও রয়েছে। কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় দলীয় প্রতীকের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। নির্বাচন কমিশন জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করায় অনেক নেতাই বাস্তবতার চাপে বড় দলে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এটিকে ‘অনৈতিক’ না বলে একটি কৌশল হিসেবে বর্ণনা করছেন।
প্রসঙ্গত, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
দেশে সামরিক সরকারগুলোর সময়ে প্রায়শই দলবদলের ঘটনা ঘটতো। পরে রাজনৈতিক বিভিন্ন সময়ে কৌশল হিসেবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে অনেক দল। কিন্তু নির্বাচনের আগে নিজ দলই বিলুপ্ত করে বড় দলে যোগ দেওয়া- এবার নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এমপি হওয়ার চেষ্টা ও নৈতিকতা
গত অক্টোবরে সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ বা আরপিওতে সংশোধনী এনে নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে-এমন ধারাও যুক্ত করা হয়।
মূলত এরপরেই বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পথ চলা কিছু ছোটো দলের নেতাদের মধ্যে দল ছেড়ে বিএনপিতে বিলীন হওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
বিএনপির অনেক দিনের মিত্র দল বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) এর চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম দল বিলুপ্ত করে দলের নেতা–কর্মীদের নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। এরপর তাকে লক্ষ্মীপুর–১ আসন থেকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয় দলটি।
এরপর ২৪ ডিসেম্বর এলডিপি (অলি) এর মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ পদত্যাগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। তার দলের চেয়ারম্যান অলি আহমদ পরে জানান, রেদোয়ান আহমদ দলের নিজস্ব এক বৈঠকে অংশ নেওয়ার পর তাকে কিছু না জানিয়েই বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন।
এরপর বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা-ও তার দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জের একটি আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন।
এ ছাড়া নিজ দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ।
ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২ ও ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩ আসন থেকে বিএনপির প্রতীকে বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিবেন বলে জানিয়েছেন।
তবে ববি হাজ্জাজ জানান, এনডিএম চেয়ারম্যান হয়েও বিএনপির প্রার্থী হওয়াটা পুরোটাই একটা ‘রাজনৈতিক কৌশল’।
এসব প্রার্থী ও নেতারা ছাড়াও বিএনপির নেতাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাহলো মূলত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে জয় নিশ্চিত হবে এবং ভোটের অনুপাতে পরে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সময় ধানের শীষের অনুকূলে বেশি ভোট দেখানো যাবে- এ দুটি কারণেই জোটবদ্ধ কিংবা সমমনা দলের নেতাদের সরাসরি বিএনপিতে এনে মনোনয়ন দিচ্ছে বিএনপি।
তবে বিএনপির সমর্থন পাওয়া গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না জানিয়েছেন যে, তারা নিজ দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করতে আগ্রহী।
তবে এভাবে দল বিলুপ্ত করে বা দল ছেড়ে এসে বেশি আলোচনা হয়েছে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে নিয়ে। তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের মনোনয়ন পেয়েছেন।

রাশেদ খান জানান, তাকে যে আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেটি বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা।
তিনি বলেন, সেখানে নির্বাচনে জেতার জন্য ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে বলে মনে করেছি।
কিন্তু গণঅধিকার পরিষদের মতো একটি নতুন তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দলের একজন শীর্ষনেতার এমপি হওয়ার জন্য এভাবে দল ছেড়ে বিএনপি যোগ দেওয়ার ঘটনায় পুরো বিষয়টিই নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে।
তার বিদায়ের পর গণঅধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়া হাসান আল মামুন বলছেন, প্রক্রিয়াটি দৃষ্টিকটু হলেও গণঅভ্যুত্থানের পরের সংসদে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক সেটি তারা চান। নির্বাচনে মার্কা গুরুত্বপূর্ণ-এটি বিবেচনায় নিয়ে রাজনীতির বাস্তবতায় রাশেদ খানকে বিএনপিতে যেতে হয়েছে।
আরও পড়ুন:
তিনি বলেন, গণঅধিকার পরিষদ বা এনসিপির মতো নতুন দলগুলো এখন নিজ প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হবার মতো সাংগঠনিক ভিত্তি জনভিত্তি তৈরি করে পারেনি বলেই কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হচ্ছে।
অর্থাৎ এ থেকে অনেকটাই পরিষ্কার যে হয়তো বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের সমঝোতার ভিত্তিতেই রাশেদ খান বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন, যাতে করে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে তিনি জয়ী হয়ে সংসদে যেতে পারেন।
‘মার্কার জন্য বড় দলের কাছে ছোটো দলের আত্মসমর্পণ?’
দল ছেড়ে বা দল বিলুপ্ত করে বিএনপির মতো বড় দলে মিশে নির্বাচন করার এ চেষ্টাকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ‘মার্কার জন্য বড় দলের কাছে ছোটো দলের আত্মসমর্পণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। আবার কেউ বলছেন, ‘ক্ষমতার ভাগ নিশ্চিত করতেই এমপি হতে চাইছেন ছোটো দলের নেতারা’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ছোটো দলগুলোর নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে নিজেদের ওপর আস্থা নেই কিন্তু এসব দলের নেতারা এমপি হওয়াটা নিশ্চিত করতে চান বলেই এমন দৌড়ঝাঁপ চলছে।
তিনি আরও বলেন, তারা জানেন যে নিজেরা দলীয়ভাবে জিততে পারবেন না। সেজন্যই দল বিলুপ্ত করে বা দল ছেড়ে বিএনপিতে যাচ্ছেন। আসলে রাজনীতি করতে গেলে ক্ষমতার ভাগ চায় সবাই। আর সবাই জানে যে সংসদে ঢুকলেই থাকবে অর্থ, বিত্ত ও প্রতিপত্তির হাতছানি। আবার এই নির্বাচনটায় যে সুযোগ সামনে আর তা নাও হতে পারে। এ জন্যই নীতি ও আদর্শহীনতার এ চর্চা দেখা যাচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে।
আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, মনোনয়ন ও নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্রই হোঁচট খাচ্ছে কারণ ছোটদল গুলো আত্মসমর্পণ করছে মার্কার কাছে।
তিনি আরও বলেন, তবে নির্বাচন কমিশনের একটি ভ্রান্ত নীতির কারণেই এটি হচ্ছে। নিজ দল বা জোটের প্রধান দলের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ আগের মতো রাখা হলে এমন দৃষ্টিকটু চর্চা দেখা যেতো না। আর এমপির কাজ আইন প্রণয়ন করা হলেও বাংলাদেশে একজন এমপি একটি এলাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে যান। সে কারণেই নিজের দল বিলুপ্ত করে হলেও এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। কারণ জয়ের জন্য মার্কা এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র: বিবিসি বাংলা
/এএস

