রোববার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘মার্কার সুবিধা’ পেতেই কি দল ছাড়ার হিড়িক?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

‘মার্কার সুবিধা’ পেতেই কি দল ছাড়ার হিড়িক?

অতীতের মতো এবারো জোটগতভাবে নির্বাচনে নামছে অনেক রাজনৈতিক দল। তবে এবারের নির্বাচনী সমীকরণে যে বিষয়টি সবচেয়ে চোখে পড়ছে, তা হলো-দল ছেড়ে দেওয়া, এমনকি দল বিলুপ্ত করে বড় দলে যোগ দেওয়ার অভূতপূর্ব হিড়িক, যা এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি। নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকার প্রশ্নে আদর্শ নয়, বরং দলীয় প্রতীক বা মার্কাই যেন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। নতুন নির্বাচনী বিধান, ভোটের অঙ্ক আর উচ্চকক্ষের সমীকরণ-সব মিলিয়ে ছোট দলগুলোর সামনে তৈরি হয়েছে অস্তিত্বের সংকট, যা প্রতিফলিত হচ্ছে একের পর এক নেতা ও দল বড় দলে যোগ দেওয়ার ধারা থেকে।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর গড়া রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন শনিবার।


বিজ্ঞাপন


যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়ন পান।

সম্প্রতি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদও দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছে ধানের শীষে নির্বাচন করার জন্য। ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে দল বিলুপ্ত করার নজিরও স্থাপন করা হয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী শরিক দলের প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ ছিল জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু গত নভেম্বরে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে সংশোধনী আনলে এই পথ বন্ধ হয়ে যায়।

বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল আইন পরিবর্তনের অনুরোধ জানালেও লাভ হয়নি। ইসির সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে গিয়েও সিদ্ধান্ত পক্ষে আসেনি।


বিজ্ঞাপন


যে কারণে শেষ পর্যন্ত হয় দল বিলুপ্তি করে কিংবা নিজ দল থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিতে হচ্ছে তুলনামূলক ‘স্বল্প পরিচিত’ রাজনৈতিক দলের নেতাদের।

শনিবার বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পর রাশেদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনে জেতার মার্কা বা দলীয় প্রতীক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির শরিক দলগুলোর একাধিক নেতা বলেছেন, প্রথমত বিএনপি এবং তারা নিজেরাও মনে করছেন নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হলে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না ভোটের রাজনীতিতে।

অন্যদিকে, এই নির্বাচনের ভোটের হারের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হওয়ার কথা রয়েছে। সেটিও একটি বড় কারণ হিসেবে দলগুলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় দলের আধিপত্যের ফলে আস্তে করে হারিয়ে যেতে পারে ছোট দলগুলো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ছোট রাজনৈতিক দলগুলো যখন বড় দলগুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তখন সে কিন্তু শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক থাকছে, হারিয়ে যাচ্ছে তার নিজের আদর্শ আর কর্মসূচি।’

চ্যালেঞ্জে ফেলেছে আরপিও সংশোধন

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

ওই নির্বাচনের আগেই জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত করেছিল নির্বাচন কমিশন। যে কারণে জামায়াতসহ ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থীই শরিক জোটের ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়েছিল নির্বাচনে।

কেননা, তখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও অনুযায়ী শরিক দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আরপিওতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

bnp=1
বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ করছেন কয়েকটি দল।

২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে-এমন ধারাও যুক্ত করা হয়।

জোট করলেও দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করার বিধান নিয়ে তখন আপত্তি জানিয়েছিল বিএনপি। দলটি নির্বাচন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে তাদের আপত্তির কথা জানায়।

তবে বিপরীত অবস্থান ছিল জামায়াত ও তাদের সমমনা আটটি রাজনৈতিক দলের। জামায়াতে ইসলামী ইসিকে সংশোধনের পক্ষে থাকারও আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে।

তখন বিএনপি জোটভুক্ত হতে আগ্রহী কিছু ছোট দলের মধ্যেও সরকারের এই সিদ্ধান্তে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। তবে বিএনপি ও কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের আপত্তির পরও শেষ পর্যন্ত ওই বিধান রেখেই গত নভেম্বরে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার।

পরে নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছিল এনডিএমসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল, যদিও উচ্চ আদালতের রায়ও তাদের পক্ষে আসেনি।

যে কারণে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে থাকার জন্য ছোট দলগুলো হয় ভাঙতে হচ্ছে, না হয় শেষ পর্যন্ত দল থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিতে হচ্ছে দলগুলোর নেতাদের। তাদের একজন এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ।

ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘আগে আরপিওর যে নিয়ম ছিল সেখানে আমরা চাইলেই ধানের শীষে নির্বাচন করতে পারতাম। পরে ষড়যন্ত্র করে আরপিওতে পরিবর্তন করা হয়েছে। যে কারণে মার্কা বা প্রতীকের যথাযথ ব্যবহার করতেই অনেকে দল ছাড়ছে বা বিলুপ্তি করছে নিজ দল।’

উচ্চকক্ষের আসন ও ভোটে জেতার কৌশল

গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আলোচনা জোরদার হয়।

তফসিলের আগেই দুই ধাপে ২৭২টি আসনে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করে তাদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। বাকি আসনগুলোর অধিকাংশই শরিক জোটের জন্য ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

নতুন আরপিও অনুযায়ী বিএনপির সঙ্গে জোট করেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ না থাকায় এখন পর্যন্ত দুইটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা নিজ দল বিলুপ্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নিজেদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছেন। কেউ কেউ আবার নিজ দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপিতে।

তাদেরই একজন রাশেদ খান যিনি গণঅধিকার পরিষদ ছেড়েছেন। রাশেদ খান বলেন, ‘আমাকে যে আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেটি বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে নির্বাচনে জেতার জন্য ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে বলে মনে করেছি। তাই বিএনপির সদস্য হয়ে ধানের শীষে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

নির্বাচনে জয়ের পর কি আর নিজের গড়া দল গণঅধিকার পরিষদে ফিরতে পারবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন- ‘সেই উত্তর ভবিষ্যতই বলে দেবে।’

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের জন্য ঢাকা-১৩ আসনটি ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। এই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন তিনি।

বিএনপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে ববি হাজ্জাজ বলছেন, ‘টেকনিক্যালি আমি বিএনপিতে যোগ দিয়েছি, আমি ধানের শীষ মার্কায়ই নির্বাচন করব।’

জোটের প্রতীকে ভোট করা নিয়ে কৌশলগত অবস্থানের একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ববি হাজ্জাজ। ‘এবারের নির্বাচনের সংসদের নিম্নকক্ষের ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। তাই এটা একটা কৌশলও বটে। কেননা আমরা যদি ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করি সেটি দিয়ে উচ্চ কক্ষের একটি আসন জয় সম্ভব নাও হতে পারে।’

নিজ প্রতীকেই ভোটে আগ্রহী অনেকেই

ধানের শীষে নির্বাচন করতে বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা বিএলডিপির একাংশের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম গত ৮ ডিসেম্বর তার দল বিলুপ্তি করে নেতাকর্মী নিয়ে বিএনপিতে যোগ দেয়। পরে তাকে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

সমমনা ১২ দলীয় জোটের আরেক শীর্ষ নেতা জোটের মুখপাত্র ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শে গত ২২শে ডিসেম্বর জাতীয় দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগদান করেন এহসানুল হুদা।

তবে বিএনপির শরিকদের মধ্যে দুটি দলের শীর্ষ নেতারা নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আগের অবস্থানে অনড় আছেন।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বিএনপি জোটের সমর্থন পেলেও তিনি নিজ দলের ট্রাক প্রতীকেই নির্বাচন করছেন। যে কারণে তাকে দল ছাড়তে হয়নি।

বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি।

প্রথমে তার গুলশান বনানীর অন্তর্ভুক্ত ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ভোলা-১ আসন থেকেই বিএনপি জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন।

তবে পার্থ জানান, এখন পর্যন্ত নিজ দলের প্রতীক ‘গরুর গাড়ি’ মার্কায়ই নির্বাচন করার ব্যাপারে তিনি অনড়। তবে সেটা এখনো চূড়ান্ত নয়। রোববার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।

গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি লড়বেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়-৬, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী সাইফুল হক লড়বেন ঢাকা-১২ আসনে। এই দুটি দলই তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

সাইফুল হক বলেন, ‘আমাদের কোদাল মার্কা একটি পরিচিত প্রতীক। আমরা আমাদের প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেব।’

শরিক যেসব দলের জন্য বিএনপি আসন ছেড়েছে তার মধ্যে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তার দলের নির্বাচনী প্রতীক কেটলি। ঋণ সংক্রান্ত জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি-না তা নির্ভর করছে আদালতের ওপর।

জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার পিরোজপুর-১, ইসলামী ঐক্যজোটের রশিদ বিন ওয়াক্কাস যশোর-৫ ও এনপিপি বা ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ লড়বেন নড়াইল-২ আসন থেকে।

তাদের কেউ কেউ এখন পর্যন্ত নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার ব্যাপারেই আগ্রহী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন সংসদে যেতে গিয়ে যখন ছোট রাজনৈতিক দলগুলো বড় রাজনৈতিক দলে বিলীন হয়ে যায় তখন সেই দলগুলো আর ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এখানে একটা দল তৈরি হচ্ছে, আবার দলগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে জোট ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতিতে। এখন দল করা মানেই সংসদে জয়লাভ করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে দলগুলোর কাছে।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর