শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সুসময়েও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না বিএনপির

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সুসময়েও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না বিএনপির

# খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় উদ্বেগ

# তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে উচ্ছ্বাস, আছে শঙ্কাও


বিজ্ঞাপন


# প্রার্থী ঘোষণায় মাথাচাড়া দিয়েছে দলীয় কোন্দল

# ‍আসন সমঝোতায় জোটে টানাপোড়েন

আলোচিত এক এগারোর সময় জিয়া পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার, দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজাপ্রাপ্তির ফলে কঠিন অবস্থায় পড়েছিল বিএনপি। পরবর্তীতে একাধিক নির্বাচন হলেও ক্ষমতার দেখা পায়নি দলটি। টানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে মামলা-গ্রেফতারের মুখে পড়ে লাখ লাখ নেতাকর্মী।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপির মধ্যে ফিরে আসে সুসময়। হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দেখা যায় ফুরফুরে মেজাজ। কিন্তু ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে দলটিতে।


বিজ্ঞাপন


বিএনপির প্রধান উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা। নভেম্বরের শেষ দিক থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। নেতারা উদ্বিগ্ন, চিকিৎসকরাও আপাতত সুখবর দিতে পারছেন না। অন্যদিকে দীর্ঘ ১৮ বছর পর দেশে ফেরার ঘোষণায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। তবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত শঙ্কা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। তার দেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া চলছে।

দলীয় প্রার্থী ঘোষণা পর কোন্দল ও গ্রুপিং মাথাচাড়া দিয়েছে। ব্যক্তিগত ও পরিবারের নিরাপত্তার কারণে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী মো. মাসুদুজ্জামান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়া আসন সমঝোতা নিয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েন দলটিকে অস্বস্তিতে রেখেছে।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে বিএনপিকে। চিকিৎসকরা আপাতত সুখবর দিতে না পারায় নেতাকর্মীদের দিন কাটছে উদ্বেগের মধ্যে।

অন্যদিকে দীর্ঘ ১৮ বছর পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘোষণায় নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। নানা সময় তার দেশে ফেরার কথা থাকলেও সম্প্রতি দিনতারিখ সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছে বিএনপি। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৫ ডিসেম্বর দেশের মাটিতে পা রাখবেন তারেক রহমান।

Khaleda
সংকটাপন্ন অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

বহুল প্রতীক্ষিত এই মুহুর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে বিএনপি একদিকে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তারেক রহমানের নিরাপত্তার ইস্যু। নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি, সবশেষ জুলাইযোদ্ধা ওসমান শরিফ হাদির ওপর গুলির ঘটনা বিএনপির উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

যুবদলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা কিছুটা আক্ষেপের সুরে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের আসলে সুসসময় আর এলো না। কয়েক বছরে ম্যাডাম একাধিকবার অসুস্থ হয়ে আবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। এবারের পরিস্থিতি তো ভিন্ন। চাইলেও টেনশন না করে থাকতে পারছি না।’

জানা গেছে, তারেক রহমানের ফেরার দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানী ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাগম ঘটাতে চায় বিএনপি। তবে দুশ্চিন্তা তার নিরাপত্তা নিয়ে। যে কারণে বিএনপি বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তার নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) চাইবে।

যদিও তারেক রহমানের নিরাপত্তায় দলীয়ভাবেও উদ্যোগ নেওয়া আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় নিয়োজিত ‘চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)’ পুনর্গঠন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সিএসএফের সদস্য সংখ্যা। নতুন করে সিএসএফের দায়িত্ব নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) একেএম শামসুল ইসলাম। ঢাকায় ফেরার পর তারেক রহমানের নিরাপত্তায় সিএসএফ কাজ করবে।তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের নিরাপত্তায় এখন কাজ করছে সিএসএফ।

যদিও এর আগে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়ার জন্য এসএসএফ নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা এসএসএফ প্রটোকল পাবেন না বলে জানিয়েছিলেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।

এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সবচেয়ে বড় দলের গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা। যে কারণে তার নিরাপত্তার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় আমরা তার নিরাপত্তার জন্য শিগগির সরকারের কাছে আবেদন করব। আশা করি সরকার সব কিছু বিবেচনা করেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।’

এর আগে তারেক রহমানের ব্যবহারের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও গুলশানের বাড়ি প্রস্তুত করেছে বিএনপি।

tarek
বিজয় দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন তারেক রহমান। তিনি ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন।

বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে দল পরিচালনার পর তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি বিএনপির সাংগঠনিক গতি বাড়াবে। একইসঙ্গে তার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি ও নেতৃত্বের ঘাটতি অনেকটাই কাটবে।

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ইতোমধ্যে ২৭৫টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ভাষায়, এই নির্বাচন তাদের কাছে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চূড়ান্ত লড়াই’। জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপকে নিজেদের অনুকূলে দেখলেও প্রার্থী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি এলাকায় দলীয় কোন্দল দেখা দিয়েছে। এসব বিরোধ দ্রুত মীমাংসা না হলে নির্বাচনী প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রার্থিতা নিয়ে অর্ধশতাধিক আসনে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কোথাও হয়েছে বিক্ষোভ, কোথাও অবরোধ করেছেন মনোনয়ন বঞ্চিতদের সমর্থকরা। দুই পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনাও আছে একাধিক। দল মনোনীত প্রার্থীকে সরাসরি অবাঞ্ছিত করার ঘটনাও আছে। 

এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি বেশ কিছু আসনে প্রার্থী বদলও করতে পারে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এক বক্তব্যে এমন ইঙ্গিতও মিলেছে। তিনি বলেছেন, প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম ঘোষণা হয়েছে এটা প্রাথমিক তালিকা। এটাই চূড়ান্ত তালিকা নয়।

বিএনপি অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। বৈঠকে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে নানা গাইডলাইন দেওয়া হচ্ছে।

bnp-specialঅন্যদিকে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে উঠেছে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা। শরিক দলগুলোর অভিযোগ, দীর্ঘদিন একসঙ্গে আন্দোলন করলেও প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে বিএনপি একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জোটের ভেতরে অসন্তোষ ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপি ইতোমধ্যে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। যেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে শরিকদের বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীদের আসন ছাড়ের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যাদের বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয় তাদের দল ক্ষমতায় গেলে মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপি নেতারা আশা করছেন, আলোচনার মাধ্যমে আসন সমঝোতাসহ অন্যান্য জটিলতার সমাধান হবে।

অবশ্য আসন সমঝোতার বিষয়ে বিএনপির বৈঠকের আগে শক্ত অবস্থানে থাকলেও কিছুটা নমনীয়তা দেখা দিয়েছে মিত্রদলগুলোর মধ্যে। আসন সমঝোতার আলোচনার আগে প্রয়োজনে মিত্র দলগুলো মিলে আলাদা জোট করে নির্বাচন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।

ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা আশা করি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। বিএনপি তার দীর্ঘদিনের রাজপথের শরিকদের দাবি-দাওয়া গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেসব দল বিএনপির সঙ্গে ছিল তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো আমরা বিবেচনা করছি। তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। আশা করি বাস্তবতা বিবেচনা করে শিগগিরই একটা সুরাহা হবে।’

বিইউ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর