- দলে-দলে চলছে টানাপোড়েন
- মনোকষ্টে বিএনপির মিত্ররা, ক্ষোভ কমানোর চেষ্টায় হাইকমান্ড
- সংকট কাটেনি জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন জোটেও
- জোট করেও স্বস্তি নেই তরুণ তুর্কীদের
সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই জটিল হয়ে উঠছে জোটের সমীকরণ। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর পাল্টে যাওয়া প্রেক্ষাপটে ঘোষণা হয়েছে নির্বাচনের তফসিল। তার আগেই শুরু হয়েছে দলে-দলে জোট গঠন, ভাঙা, আসন সমঝোতা ও দরকষাকষির দৌড়ঝাঁপ।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনের বাইরে থাকায় দলগুলো এখন বড় কোনো জোটে জায়গা পেতে মরিয়া। কিন্তু আসন–চাহিদা, ক্ষমতার সমীকরণ ও নেতৃত্ব নিয়ে একের পর এক জোটে তৈরি হচ্ছে উত্তাপ, ক্ষোভ আর অভিমান, যা পুরো বিরোধী অঙ্গনকে জটিল করে তুলেছে।
নির্বাচনের আগে অন্তত পাঁচটি বড় জোট সক্রিয়। যেসব দল এখনো জোটে নেই, তারা যেকোনোভাবে কোনো বড় জোটের ছায়ায় ভোটযুদ্ধে নামতে চাইছে। তবে সবচেয়ে বড় বাধা আসন বণ্টন। ছোট দলগুলো চায় নিজেদের তুলনায় বেশি আসন পেতে। বিপরীতে বড় দলগুলো বেশি আসন ছাড়তে নারাজ। এমন অবস্থায় প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়, কারো কারো জোট ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
ভোটের আগে জটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আসন নিয়ে মতবিরোধ তীব্র হয়েছে। ২৭২টি আসনে নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা করলেও বাকি ২৮টি আসনের অর্ধেকও ঠিক করতে পারছে না বিএনপি। এমন পরিস্থিতি জোটে উত্তাপ দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি গুলশানে অনুষ্ঠিত বিএনপি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির বৈঠক অস্বস্তিকর পরিবেশে শেষ হয়। আলোচনা মনোপুত না হওয়ায় দলের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক ক্ষুব্ধ হয়ে বৈঠকস্থল ছেড়ে চলে যান। নিজের আগ্রহের আসনে বিএনপি প্রার্থী দেওয়ায় লেবার পার্টি বিএনপির সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বিদায় বেলায় বিএনপি বেঈমানি করেছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
ঢাকা মেইলকে মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘বিএনপি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। তারা বেঈমানি করেছে। লেবার পার্টি নিবন্ধিত দল। কোনো জোটে না গেলে আমরা এককভাবে নির্বাচন করব। কিন্তু আত্মসম্মান বিজর্সন দেওয়া যাবে না।’
আসন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় গণঅধিকার পরিষদ বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতসহ ৮দলীয় জোটের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বলে জানা গেছে। চাহিদামাফিক আসন পাওয়ার নিশ্চয়তা না পেয়ে বিএনপিকে নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন দলীয় প্রধান নুরুল হক নুরও।
নুরুল হক নুর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজে কথা বলে আসন দিতে চেয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা বিক্রি হইনি। এখন একটা দুইটা আসন দিতে চাইলে তা নেওয়া অসম্ভব।’
জামায়াত–ইসলামী আন্দোলনের জোটেও টানাপোড়েন
অন্যদিকে রাজনীতিতে ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে উঠতে চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী-ইসলামী আন্দোলনসহ ৮ দলের জোট। তারা ঘোষণা করেছে ‘ওয়ান বক্স পলিসি’ প্রতি আসনে একজন প্রার্থী। কিন্তু এখানেও জট রয়েছে। জামায়াতকে বেশি আসন দিতে চাইলে ক্ষুব্ধ ছোট দলগুলো। সমঝোতা করতে দুই দফা বৈঠক করলেও সমাধান হয়নি।
শরিক দলের এক নেতা বলেন, ‘সবাই যদি ছাড় দিতে রাজি হতো, এই জট অনেক আগেই কাটতো। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে আসন সমঝোতা হয়নি বলে জানা গেছে।
এনসিপির জোটেও নেই স্বস্তি
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী তরুণ নেতৃত্বও পিছিয়ে নেই। এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’। এনসিপি ইতোমধ্যে প্রথম দফায় ১২৫ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। আরও নতুন দল এতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
রাজনীতিতে কোণঠাসা জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভেঙে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’-১৮ দলের জোট। তবে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে দাঁড়াতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ তরুণ নেতৃত্ব ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে নির্বাচনে না থাকার দাবি তুলেছে।
যদিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে সুবিধা নেওয়া জাতীয় পার্টি ভোটের মাঠে কতটা সুবিধা করতে পারবে, আদৌ অংশ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা নেতাকর্মীরা জাপাকে ভোটের বাইরে রাখার দাবি তুলছে।
বাম দলগুলোও পিছিয়ে নেই। নয়টি দল নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’। আন্দোলন ও নির্বাচনে একসঙ্গে কাজের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা স্বতন্ত্র থাকবে নাকি কোনো বড় জোটে যুক্ত হবে-সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয়।
মিত্রদের শান্ত করার চেষ্টায় বিএনপি
আসন পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকা বিএনপির মিত্র দলগুলো গত সপ্তাহে বৈঠক করে। যেখানে ২৯টি দলের প্রতিনিধিরা আসন নিয়ে সমাধান না হলে বিএনপি থেকে পথ আলাদা করে নতুন নির্বাচনি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমস্যা সমাধানে সেখান থেকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দেওয়া হয়।
মিত্রদের এমন সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে শনিবার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা। যেখানে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচন, যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, আসন সমঝোতা এবং নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হবে এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো হবে। এক্ষেত্রে অতীতে শরিক এবং মিত্রদের বিএনপি ২৫টি আসনে ছাড় দিয়েছিল, এবারো যেন তেমন মূল্যায়ন করা হয় সেই আশা করছেন দলগুলোর নেতারা।
দলগুলোর শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি একলা চলো নীতিতে এগোচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপি বন্ধু ছেঁটে ফেলার কৌশল নিয়েছে, যা দলটির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
বৈঠকের বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেন পারস্পরিক সন্দেহ তৈরি না হয়। আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ আসন নিশ্চিত না হলে, এ নিয়ে দায়সারা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা বিএনপির জন্য আত্মঘাতি হবে।
সার্বিক জোট–অস্থিরতা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমরা আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত আছে। আমরা আশা করি-সমাধান বের হবে।’
নতুন নতুন জোট ইতিবাচক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অবাধ নির্বাচনের জন্য সবাই প্রস্তুত। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা জরুরি।’
বিইউ/এমআর/ক.ম

