ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সামাজিক মাধ্যমে ততই ভুয়া তথ্যে সয়লাব হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-নির্ভর ভুয়া ভিডিও, নকল ফটোকার্ড আর মনগড়া উদ্ধৃতি ছড়িয়ে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একের পর এক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না বিএনপির শীর্ষ নেতারাও। তাদের নিয়েও একের পর এক গুজব ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমানের মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজামান দুদুকে ঘিরে একের পর এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও দলটির অন্যান্য নেতাদের নিয়েও এমন ভুয়া ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। খোদ নেতাকর্মীরাও যাচাই-বাছাই না করে সেসব ভিডিও শেয়ার দিচ্ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও কীভাবে চিনবেন?
‘হ্যাং করে তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমান লাইভে’-এমন ক্যাপশনে একটি ভিডিও প্রায় ১৫ হাজার ফেসবুক পেজ থেকে শেয়ার হয়েছে। সেখানে জায়মা রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘তারেক রহমান অতি দ্রুত দেশে আসবেন।‘
১০ ডিসেম্বর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওটি দেখা হয় ২০ লক্ষেরও বেশি বার। ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘প্রিয় দেশবাসী, তারেক রহমান অতি তাড়াতাড়ি দেশে আসবেন। আপনারা কেউ দুশ্চিন্তা করবেন না। তারেক রহমানকে নিয়ে অনেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।’
তবে ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যারিস্টার জাইমা রহমানের ‘বাবার দেশে ফেরা’ সম্পর্কিত কথার এই ভিডিওটি আসল নয়। ফ্যাক্টচেক করে নিশ্চিত হওয়া গেছে-এটি এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য গত নভেম্বরে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন জাইমা রহমান। সেখানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। সেখানে তারেক রহমানের মেয়ে দেশের জন্য বিএনপির পরিকল্পনা, নানা ভাবনার প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকা বিএনপির এক নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি তো সেই অনুষ্ঠানে ছিলাম। কোথায় সেখানে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কোনো কথা জাইমা রহমান বলেননি।’ পরে ফ্যাক্টচেক করে জানা যায়, ভিডিওটি আসল নয়; এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি।
এর কিছুক্ষণ পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘিরে ছড়াতে থাকে দুটি গুজব। একটিতে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিও নেবে না। ভুয়া ওই পোস্ট আবার শেয়ার হয়েছে অর্ধ হাজারের বেশি। দিনের শেষ ভাগে আরও একটি গুজব ছড়ায়-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু নাকি নিজ দল বিএনপিকে নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে টিকটকে দৈনিক ‘সমকাল’ এর নামে তৈরি একটি নকল ফটোকার্ডে দাবি করা হয়-মির্জা ফখরুল বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নাকি বলেছেন- ‘ইতিহাস হয়ে থাকবে, শেখ হাসিনার ভয়ে রাজনীতিবিদরা ঐক্য হারিয়ে ফেলেছেন।’ ফটোকার্ডটি প্রায় ৬৫ হাজার বার দেখা হয়েছে।
ওই পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়, নেতারা নাকি রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার পথে। তবে যাচাই করে দেখা গেছে-এসব শিরোনামে সমকাল কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদ প্রকাশ করেনি। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় গণমাধ্যমটির ফরম্যাট নকল করে বিভ্রান্তিকর ফটোকার্ডটি তৈরি করা হয়েছে।’
পরে আবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের ডিজাইন ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি নকল ফটোকার্ডে দাবি করা হয় বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেবে না।’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবিটি মিথ্যা। কারণ মির্জা ফখরুল এমন মন্তব্য করেননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনও এমন কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদ প্রকাশ করেনি। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদপত্রটির ফরম্যাট নকল করেই গুজবটি ছড়ানো হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজামান দুদুর উদ্ধৃতি সম্বলিত একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, বিএনপি নেতা নাকি বলেছেন ‘আমাকে ব্যবহার করে টিস্যুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দিল বিএনপি।’ পোস্টে শামসুজ্জামানের ছবিও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ফ্যাক্টচেক করে দেখা গেছে- তিনি নিজ দলকে নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করেননি। কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন দাবিটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম রাইজিংবিডির নাম ব্যবহার করে সাম্প্রতি একটি ছবি ছড়ানো হয়। যেখানে দাবি করা হয়-ডাকসু ভবনের প্রবেশদ্বারের মেঝেতে পাঁচ দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ভারতের পতাকা লাগানো হয়েছে।
রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকসুর প্রবেশদ্বারের মেঝেতে পাঁচ দেশের নয়, কেবল পাকিস্তানের পতাকা লাগানো হয়েছিল। ভাইরাল ছবিটি এআই দিয়ে সম্পাদিত, এবং সেখানে গুগলের এআই ‘জেমিনি’ এর লোগোও দেখা গেছে।
এদিকে গত ৫ ডিসেম্বর কুমিল্লা নিউজের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ‘খালেদা জিয়া–তারেক রহমানের ছবি ভাঙচুর করল ছাত্রদল’ শীর্ষক একটি ফটোকার্ডও বিকৃত করা হয়। মূল ফটোকার্ডের সব উপাদান একই রেখে শুধু শিরোনাম বদলে দেওয়া হয়- ‘খালেদা জিয়া–তারেক রহমানের ছবি ভাঙচুর করল শিবির।’ কুমিল্লা নিউজের ফটোকার্ড সম্পাদনা করেই ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ ছড়ানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে আপত্তিকর, সংবেদনশীল এবং উস্কানিমূলক মন্তব্য যোগ করে তৈরি হচ্ছে এমন নকল ফটোকার্ড। এগুলো ছড়ানো হচ্ছে সংগঠিতভাবেই। এর বাইরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ছড়ানো হচ্ছে আরও নানান অপতথ্য। এই কঠিন বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে নয়, বরং গণমাধ্যমের যাচাইকৃত খবরেই আস্থা রাখা উচিত।
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহ-সম্পাদক সাইফ আলী খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমরা সবসময় অ্যালার্ট আছি। তারপরও আমরা দেশের সকল রাজনৈতিক দল, নেতাকর্মীদের কাছে অনুরোধ করব কেউ কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে বিরত থাকতে। কারণ মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সফল হওয়া যায় না। প্রযুক্তির এই যুগে সত্য বের হয়ে আসবেই। আমরা যদি নতুন বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই তাহলে যারাই এমন গুজব কিংবা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় তাদের এসব বন্ধ করতে হবে।’
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির এই নেতা বলেন, এর আগেও দলের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে যেকোনো তথ্য যাচাই না করা পর্যন্ত যাতে কেউ তা শেয়ার না করে। এখনকার তরুণরা সবাই ফ্যাক্টচেক করতে পারেন। যাচাই করে, বুঝেশুনে তথ্য প্রচার করতে সবার প্রতি অনুরোধ করব।’
গত জুনে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানের নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলেছে জানায় বিএনপি।
বিএনপি বলেছে, ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে অসত্য ও বানোয়াট পোস্ট, মন্তব্য এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তাদের ছবি ব্যবহার করে নানা ধরনের ভিডিও বানিয়ে সেসব সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানায় বিএনপি।
প্রযুক্তির এমন কারসাজি নিয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কাজ এখন সহজ হয়েছে। ছবি-ভিডিও সম্পাদনার কাজও এর মধ্যে রয়েছে। একইসঙ্গে এর অপব্যবহারও হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন উদ্ভাবন মানুষের কল্যাণের জন্যই হয়। কিন্তু এর অপব্যবহারও করে মানুষই। অপব্যবহারের জন্য প্রযুক্তির প্রসার কোনোভাবেই দায়ী নয়। প্রযুক্তির ইতিবাচক বা নেতিবাচক ব্যবহার নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছার ওপর।’
কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ‘অনলাইনে ভুয়া তথ্য (ডিসইনফরমেশন) ছড়ানো বন্ধে সচেতনতায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন রাজনৈতিক কর্মীরা। কারণ সমাজে রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। তাই প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের উচিত এ নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়তে আমরা রাজনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করি।’
বিইউ/এমআর

