শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঢাকা-৫: আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি, স্বপ্ন দেখছে জামায়াতও

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৫ এএম

শেয়ার করুন:

ঢাকা-৫: আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি, স্বপ্ন দেখছে জামায়াতও
ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নবী উল্লাহ নবী (বায়ে) এবং জামায়াত মনোনীত প্রার্থী কামাল হোসেন (ডানে)।

# আওয়ামী লীগ বিহীন মাঠে চলছে নানা হিসাব।

# প্রচারণায় সক্রিয় দলীয় কর্মীরা।


বিজ্ঞাপন


# প্রচারণা ও প্রার্থীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে উৎসাহিত ভোটাররা।

# প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও অঙ্গীকার ভোটারদের নজরে।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো তফসিল ঘোষণা করা না হলেও প্রার্থীরা প্রচারণায় ব্যস্ত। পিছিয়ে নেই ঢাকা-৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাওয়া প্রার্থীরাও। তাদের প্রচারণায় নির্বাচনমুখর হয়ে উঠেছে যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কদমতলী (আংশিক) এলাকা নিয়ে গঠিত গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটি। দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চট্টগ্রাম ও বরিশালের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত যাত্রাবাড়ী, জুলাই আন্দোলনের সময়ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান দেখিয়েছে।

এখন পর্যন্ত এই আসনে হাফ ডজন প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েছেন। তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর মধ্যে মূল লড়াই হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


ভোটার ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে নির্বাচনী উত্তেজনা স্পষ্ট। অলিগলি, মহল্লা এবং চায়ের আড্ডা-সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রে আসন্ন নির্বাচন। ভোটাররা প্রার্থী নির্বাচনকে ঘিরে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন।

বিএনপি প্রার্থী নবীউল্লাহ নবীর প্রচারণা সর্বশেষ ২০০১ সালে ঢাকা-৫ আসনে ধানের শীষের টিকিটে জয় পেয়েছিলেন কামরুল ইসলাম। এরপর থেকে দলটি আর আসনটিতে জিততে পারেনি। এবার আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া দীর্ঘ দুই দশকের মতো ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। নভেম্বর মাসের শুরুতে ২৩৭ আসনে দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বিএনপি। ঢাকা-৫ আসনে কে হবেন ধানের শীষের প্রার্থী তা নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কারণ আসনটিতে সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, তার ছেলে তানভীর আহমেদ রবিনও ব্যানার-ফ্যাস্টুন লাগিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু সালাহউদ্দিন আহমেদ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় এবং তার ছেলে তানভীরকে ঢাকা-৪ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করায় ঢাকা-৫ আসনে ধানের শীষের টিকিট পান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী। নির্বাচনে জিততে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছেন। করছেন উঠোন বৈঠক, গণসংযোগ ও পথসভা।

election-1
প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নবী উল্লাহ নবী।

সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মাতুয়াইল, ডেমরা, রায়েরবাগ এলাকার অলিগলিতে নবী উল্লাহ নবীর প্রচারপত্রে ছেয়ে গেছে। নিয়মিত উঠান বৈঠক, পথসভা ও শোডাউন করে ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন তিনি।

নবী উল্লাহ নবী বলেন, ‘দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। সরকারি চিকিৎসাসেবা, পার্ক বা স্টেডিয়াম নেই-এগুলো নির্মাণের কাজ শুরু হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের সুরক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’

স্থিতিশীল দেশ গড়তে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিকল্প নেই জানিয়ে ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি মনোনয়ন পাওয়া এই প্রার্থী বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকারের সুরক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। অন্যথায় অরাজক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বদ্ধপরিকর বিএনপি। ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে।’

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ‘দীর্ঘদিন দেশে গণতন্ত্র ছিল না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সুযোগ আসছে সামনে। জনগণ তাদের প্রিয় নেতা নবী উল্লাহকেই বেছে নেবে।’

শামসুর রহমান নামে একজন বলেন, ‘এই আসনে নবী উল্লাহ ভাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। যে কয়জন প্রার্থীকে দেখা যায় তার মধ্যে নবী ভাই সর্বজন পরিচিত। সাধারণ মানুষ যেদিকে জোয়ার দেখে সেদিকেই যাবে। তবে এবার জোয়ার কোন দিকে যায় এখনই বলা যায় না।’

ভোটারদের মন জয় করতে মরিয়া জামায়াতও ঢাকা-৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করে যাচ্ছেন জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ কামাল হোসেন।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে এই শুরা সদস্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারিরও দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবেও কাজ করেছেন। জুলাই আন্দোলনে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেন এই রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের সময় তিনি বিভিন্ন মামলায় ৯ বার গ্রেফতার হয়ে ৮৫৩ দিন কারাবরণ করেন।

ঢাকা মেইলকে কামাল হোসেন বলেন, ‘মানুষ এখন সৎ-যোগ্য নেতৃত্বের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। আমরা নিয়মিত মানুষের কাছে যাচ্ছি। ওয়ার্ডভিত্তিক গণসংযোগ চালাচ্ছি। এতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী এই আসন থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব।’

জামায়াত মনোনীত এই প্রার্থী বলেন, ‘ঢাকা-৫ আসন দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। এলাকার মানুষ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাকন সমস্যা দীর্ঘদিনের। জনগণ আমাকে নির্বাচিত করলে এসব সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার দেব। ঢাকা-৫ আসনে ভালোমানের হাসপাতাল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, খেলার মাঠ নেই। এগুলোর বিষয়ে আমাদের বিশদ পরিকল্পনা আছে। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিতে সাধারণ মানুষ উন্মুখ হয়ে আছেন। আমরা কথা দিয়েছি ‘আমার অঙ্গীকার, এমপি হবে জনতার’।

কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী গড়ে তুলব। নৈতিক সমৃদ্ধ ঢাকা গড়ব। এবার দাঁড়িপাল্লার বিপ্লব হবে। নারী-পুরুষ, জেন-জিসহ সর্বস্তরের মানুষ আমাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। জনগণের ভালোবাসাই আমাদের বিজয় নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ।’

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম নামে একজন ভোটার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগের নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন উৎসবমুখর হবে। প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা করছে।’ তবে তিনি কোনো প্রার্থীকে সরাসরি দেখেননি বলে জানান। সরেজমিনে দেখা যায়, পুরুষ ভোটারের পাশাপাশি নারী ভোটাররাও কামাল হোসেনের পক্ষে কাজ করছেন। দলটির নারী কর্মীরা বাসা-বাড়িতে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন।

election-2
ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি জামায়াত প্রার্থীর পক্ষে পোস্টার সাটানো হয় আসনজুড়ে।

মাতুয়াইলের বাসিন্দা শরীফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ঢাকা-৫ আসনের ভোটার। বিগত ৫২ বছর বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করেছে। কিন্তু আমাদের কোনো ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। দেশে জুলুম নির্যাতন, দুর্নীতি, লুটপাট কিছুই দূর হয়নি। এবার আমরা দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে দেখতে চাই।’

এই দুই দল ছাড়াও আসনটি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এখানে দলটির প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা-৫ আসনের অধিভুক্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৬৭ নং ওয়ার্ডের দুই মেয়াদের নির্বাচিত কাউন্সিলর হাজি মো. ইব্রাহীম। তিনিও নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত ইনসাফভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন হাতপাখা প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন তিনি।

হাজি ইব্রাহীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙক্ষা তৈরি হয়েছে। ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ নেই এখানে। ভালো নেতৃত্ব না এলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষদের জন্যই ক্ষতিকর। তিনি বলেন, ‘ঢাকা-৫ আসনকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলা হবে। যেখানে সব দল, মতের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকবে। আমরা পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে মাঠে নেমেছি।’ হাজি ইব্রাহীমের গণসংযোগগুলোতে স্থানীয় সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, তরুণ সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়ে হাতপাখা প্রতীকের প্রতি তাদের সমর্থন ও ভালোবাসা প্রকাশ করছেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মো. আব্দুল কাইয়ুম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা এই আসনে খুবই আশাবাদী। কারণ আমাদের প্রার্থী বেশ জনপ্রিয়। আওয়ামী দুঃশাসনেও তিনি নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দুই বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। নিয়মিত মাঠে প্রচার-প্রচারণা করে যাচ্ছেন।

আসনটিতে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী হয়েছেন দলটির সহ-সভাপতি সৈয়দ ইব্রাহিম রওনক। তিনিও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ঢাকা মেইলকে ইব্রাহিম রওনক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া চাঁদাবাজি-দখলদারি বন্ধ হয়নি। কেবল হাত বদল হয়েছে। জনগণের প্রতি আহ্বান আপনারা চাঁদাবাজ দখলদারদের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। আমরা এই এলাকার মানুষের শান্তি নিশ্চিতে কাজ করব।’

ইব্রাহিম রওনক আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম চায় চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত সমাজ। আমরা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছি। আশা করি জনগণ আমাদের পক্ষে রায় দেবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।’

এদিকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনটিতে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মার্কা শাপলা কলির কাণ্ডারি হতে চান জুলাই বিপ্লব পরিষদের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাদিল আহমেদ। গণঅভ্যুত্থানের পর সাদিল আহমেদ প্রথম যাত্রাবাড়ী অঞ্চলের শহীদ ও আহতদের তালিকাবদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে তার সংগঠন শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশের প্রথম স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন। জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাজলা অংশে ছিলেন সরব ভূমিকায়।

সাদিল আহমেদ জানান, শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে কাজ করতে চান তিনি। সাদিল বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা ও সমর্থন আমার প্রধান অনুপ্রেরণা। আমি এই অর্থকে দোয়া হিসেবে নিয়েছি।’

এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য সালাউদ্দিন জামিল সৌরভও আসনটিতে দলের প্রার্থী হতে চান বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে এখনও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সদ্য সাবেক ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিজেপি মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউদের নামও শোনা যাচ্ছে।

এমআর/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর