ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের পর এবার ভোটের মাঠে জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা নিয়ে যেতে চায় দলটি। শুধু অভিজ্ঞ নেতাদের ওপর ভরসা নয়, তরুণ, শিক্ষিত ও পেশাজীবীদের নিয়ে নতুনভাবে প্রার্থী বাছাই করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
দলটির নেতাদের মতে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের যুক্ত করলে রাজনীতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে, বাড়বে গ্রহণযোগ্যতা। তাই নির্বাচনি লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমেও চমক দেখাতে চায় বিএনপি।
বিজ্ঞাপন
দলটির শীর্ষ নেতারাও মনে করছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গুছিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আমলে ছিটকে যাওয়া ভালো প্রার্থীর সঙ্গে নতুন মনোনয়নপ্রত্যাশী যোগ হচ্ছে। ফলে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী খুঁজতে গিয়েও কিছুটা বেগ পেতে হবে। যে কারণে ভালো প্রার্থী বের করতে একাধিক মাঠ জরিপও চালানো হয়েছে। সেই জরিপের ফল এবং দলের নীতিনির্ধারণী নেতাদের মতামত ও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা বিবেচনায় অন্তত দুশোর মতো প্রার্থী দলের ইতিবাচক বার্তা পেয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে। যদিও দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, এখনো কাউকে গ্রিন সিগন্যাল বা সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি।
তবে প্রার্থী হিসেবে দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে ভেদাভেদ ভুলে তার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা ইতোমধ্যে নেতাকর্মীদের দিয়েছেন খোদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে যেসব এলাকায় একাধিক আগ্রহী প্রার্থী আছেন, দ্বন্দ্ব আছে, সেসব আসনের নেতাদের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন তারেক রহমান।
এদিকে বিএনপির এমন ভাবনাকে দলের ভেতরে-বাইরে শক্তি বাড়াবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক সাবু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার ও ক্রীড়াবিদদের রাজনীতিতে যুক্ত করার উদ্যোগ অত্যন্ত ইতিবাচক। তারা শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এনে নেতৃত্বকে আরও কার্যকরী করবে।’
বিজ্ঞাপন
সাহাবুল হক সাবু বলেন, ‘এই পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে পেশাজীবীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জনগণও নতুন সুবিধা পাবে।’
প্রার্থী চূড়ান্ত করায় আসছে ভিন্ন চিন্তা
বিএনপি মনে করছে, অতীতের মতো শুধু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া কঠিন হতে পারে। তাই এবার প্রার্থী নির্বাচনে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে সততা, স্বচ্ছতা, পেশাগত দক্ষতা ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা। যে কারণে কোথাও কোথাও হেভিওয়েট প্রার্থীও বাদ পড়তে পারেন। কোথাও কোথাও প্রবীণ নেতাদের সন্তানদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষিবিদ, খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন পেশার গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে সুবিধা করতে পারেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় শুধু বয়স নয়, বিবেচনায় থাকবে জনপ্রিয়তা, সততা, জনসেবা এবং এলাকার মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। দলের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে, কিছু আসনে হেভিওয়েট নেতাদের পরিবর্তে নতুন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
অন্যদিকে সাবেক ছাত্রনেতাদের সামনে আনার চিন্তাও আছে বিএনপি। ইতোমধ্যে নির্বাচনের মাঠ তৈরিতে কাজ শুরু করেছেন অনেক সাবেক ছাত্র নেতা।
দলীয় সূত্র বলছে, যেসব ছাত্রনেতা এলাকায় সুপরিচিত, সুনামের অধিকারী এবং যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির অভিযোগ নেই তাদেরও মনোনয়নের সুযোগ মিলতে পারে।
ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও এমন আভাস মিলেছে। তিনি বলেছেন, মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন, তরুণ প্রার্থী ও মাঠে সক্রিয় নেতারা প্রাধান্য পাবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্লিন ইমেজ, ত্যাগী, দক্ষরা অগ্রাধিকার পাবেন। ভোটারদের মধ্যে বড় অংশ তরুণ। তাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন এমন নেতা আমাদেরও খুঁজে বের করতে হবে।’
ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি একাধিক সভায় বলেছেন, আসন্ন নির্বাচন সহজ হবে না। তবে অন্তর্ভুক্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তরুণ, নারী ও পেশাজীবীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। তারেক রহমানের ভাষায়, ‘আমরা এগোচ্ছি নতুন যুগে; যেখানে সততা, তরুণ নেতৃত্ব ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হবে রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি। রাজনীতি মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হবে।’
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও তিনি লেখেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ৩১ দফা কর্মসূচি তৈরি করেছে। তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ আরও শক্তিশালী করছি। তরুণরা বাস্তব সুযোগ চায়, ফাঁকা বুলি নয়। জনগণ স্থিতিশীলতা চায়, বিশৃঙ্খলা নয়।’

সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, বিশাল দল আমাদের, এতসংখ্যক নেতাকর্মী আমাদের। থাকতেই পারে বিভিন্ন নেতাকর্মীর বিভিন্ন মতামত, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দলের যখন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাবে, আমাদের কাজ হচ্ছে দলের সিদ্ধান্তের পিছে এসে দাঁড়ানো। কারণ আপনারা ধানের শীষের কর্মী, জাতীয়তাবাদী শক্তির কর্মী আপনারা।’
আরও পড়ুন
কোথায় হারালেন ‘পল্টি’ দেওয়া সেই নেতারা?
সুযোগ পেলে বিএনপিতে ফিরবেন ৮ বার দল পাল্টানো শাহ জাফর!
তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি আগামী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রত্যেকটি নেতাকর্মী ইস্পাতের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, ইনশাআল্লাহ আমরা একটি সফল জনরায় আমাদের পক্ষে আনতে সক্ষম হবো।’
কী বলছেন মাঠের নেতারা
দলের এমন ভাবনায় নির্বাচনি মাঠে কাজ করা তরুণ, জনপ্রিয়তা আছে এমন নেতাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হচ্ছে। হাইকমান্ডের এমন ভাবনাকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যতিক্রমী চিন্তার মাঝে যাতে এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন, গ্রহণযোগ্যতা নেই এমন কেউ সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার অনুরোধ তাদের।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহ-সম্পাদক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এলাকার সাধারণ মানুষ চায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন কেউ প্রার্থী হোক। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি পেশাজীবী দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদ গঠিত হলে সেটা দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’
তরুণ-শিক্ষিতদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার ভাবনাকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভুঁইয়া মিল্টন।
ঢাকা মহানগর উত্তর ড্যাব সভাপতি ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জনগণ একজন সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রার্থীই দেখতে চায়। তারেক রহমানের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মাইলফলক হবে। পেশাজীবীদের যুক্ত করলে রাজনীতি হবে আরও সমৃদ্ধ।’
বিইউ/জেবি

