দীর্ঘদিন বিএনপি এবং জোটভুক্ত দলের রাজনীতি করলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে ভিন্ন প্লাটফর্মে গিয়ে আলোচনার জন্ম দেয় ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বিএনএম’। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল যখন নির্বাচন বর্জন করেছে তখন ভোটের মাঠে বেশি আলোচনায় ছিল এই দুটি রাজনৈতিক দলের নাম। অনেকের কাছে ‘কিংস পার্টি’, কারো কাছে ‘পল্টিবাজ’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া কোনো নেতাই নির্বাচনের মাঠে হালে পানি পাননি। জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
দুই দলের শীর্ষ ছয় নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। শুধু বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বিজয়ী হয়েছেন। সেটাও আওয়ামী লীগের সমর্থনে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ‘তৃণমূল বিএনপি’র চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী, মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও নির্বাহী চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট অন্তরা হুদা ছাড়াও বিএনএম দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, মহাসচিব ড. মুহাম্মদ শাহ্জাহান এবং দলটির সাবেক আহ্বায়ক ড. আব্দুর রহমানের মধ্যে কেউই জিততে পারেননি।
গত নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছেন এসব নেতা। কারও কোনো দেখা নেই। পুরোপুরি নীরব হয়ে গেছেন হঠাৎ আলোচনায় আসা এসব রাজনীতিক।
শুধু তাই নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে যখন সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিবিদরা সরব তখনও এসব নেতা কোথাও নেই। অবশ্য বিএনএম দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে অন্তত আটবার দল পরিবর্তন করে শাহ মো. আবু জাফর জনতা পার্টি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
অন্তরা হুদা দল থেকে বিচ্ছিন্ন। তৃণমূল বিএনপির এখন আর কোনো কাজকর্ম নেই। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে তিনি। এলাকায় দুঃস্থ-অসহায়দের মাঝে গত রমজানজুড়ে আর্থিক-সহায়তা, ইফতার আয়োজন করেছেন। দল নিয়ে মাথাব্যথা নেই। দোহার এলাকায় বেশি সময় দিচ্ছেন। তবে এখন আর কোনো কার্যক্রমই নেই তার।

নাজমুল হুদা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, অন্তরা হুদা এখনো বিএনপি থেকে বাবার আসনে ভোট করার স্বপ্ন দেখছেন। যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি দলে নেয় তাহলে ভোটের মাঠে ভালো করবেন এমন আত্মবিশ্বাসের কথাও তিনি ঘনিষ্ঠদের বলছেন।
দুই দলের হেভিওয়েটদের কী হাল হয়েছিল ভোটে
‘তৃণমূল বিএনপি ‘ ও ‘বিএনএম’-র যেসব নেতা সবশেষ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তৃণমূল বিএনপির শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ আসনে নির্বাচনে ১০ হাজার ৮৫৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ১৭ অক্টোবর শমসের মবিন চৌধুরীকে আটক করা হয়। এর পরদিন তাকে পল্টন থানায় করা যুবদল নেতা শামীম মোল্লা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে আদালতের নির্দেশে তিনি কারাগারে যান। এরপর যাত্রাবাড়ী থানায় করা পারভেজ মিয়া হত্যা মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। গত ২৫ মার্চ মুক্তি পেয়েছেন বিএনপির সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান।
এই দলের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মেয়ে ও দলের নির্বাহী চেয়ারপারসন অন্তরা হুদা মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করে মাত্র ৬ হাজার ৩৩৭ ভোট পান।
অন্যদিকে বিএনএম-এর মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট পেয়েছিলেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হয় তার।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। পরে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ হারান তিনি।
বিএনএম-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করে তৃতীয় হন। চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) থেকে নির্বাচন করা দলটির মহাসচিব ড. মুহাম্মদ শাহ্জাহানও শাহ জাফরের কাছাকাছি ভোট পেয়েছেন। বিএনএম-এর সাবেক আহ্বায়ক ড. আব্দুর রহমান বরগুনা-২ আসন থেকে লড়ে এক হাজার ৯৫২ ভোট পান। ওই আসনের নৌকার প্রার্থী পেয়েছিলেন এক লাখ ৪৮ হাজার ৩২ ভোট।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি ২৩০ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিল। আর বিএনএম ৮২ আসনে। এর মধ্যে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম দলের কতজনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নিজেরাই দিতে পারেননি। যদিও তাদের দাবি, তৃণমূল বিএনপির ১৩৯ এবং বিএনএমের ৫৭ মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে সবাই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
অবশ্য হঠাৎ করে বিএনপি জোট ছেড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বাজিমাত করেছিলেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম। হাতঘড়ি মার্কা নিয়ে বিএনপির সাবেক এই জোটসঙ্গী পেয়েছিলেন ৮১ হাজার ৯৫৫ ভোট। আর পরাজিত ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জাফর আলম পান ৫২ হাজার ৯৮৬।
সম্প্রতি নিজের ব্যস্ততা নিয়ে জানতে ফোন করা হয় সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘সব কিছু অবজারভ করছি। এখনই কোনো কথা বলতে চাই না। আরও কিছুদিন পর হয়ত সামনে আসব। তখন কথা হবে।’

আর তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গে ব্যস্ততা নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পরিস্থিতি তো ভালো না। আসলে আমূল সংস্কার দরকার। কঠিন সংস্কার না হলে রাজনীতি করার সুযোগ নেই আমাদের মতো মানুষের জন্য।’
বিএনপির রাজনীতিতে ফেরার চিন্তা আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার চৌদ্দগুষ্টি বিএনপি। যাদের রক্তে মাংসে বিএনপি তারা চাইলেও ভুলে থাকে কীভাবে। বিএনপির বি চৌধুরী, নাজমুল হুদা, তানভীর সিদ্দিকী তারাও কিন্তু বহিষ্কার হয়েছেন। বিএনপি যখন মনে করল আমার মতো গুলি খাওয়া কর্মীকে দরকার নেই, আমি কেন দরকার মনে করবো?’
বিইউ/জেবি