রাজনীতির মাঠে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ১৯৭৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি এই মুহূর্তে অনেকটা সুসময় পার করছে। কারণ আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে দলটির নেতাকর্মীকে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনীতির ভেতরে-বাইরে সবখানেই ফুরফুরে মেজাজে আছে দলটি। তবে ত্রয়োদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ নিয়ে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের কপালে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মাঠে থাকা একাধিক দল নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করছে। আবার হঠাৎ করে অস্থিতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে আবারও এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে বিএনপিতে।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে মামলার জাল থেকে বের হতে পারলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন- এমন জোরালো আলোচনা ছিল বিএনপিতে। নেতাকর্মীদের ভয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তার দেশে ফেরা আটকে যেতে পারে। যদিও সরকারের সুরে বিএনপিও বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।
একইসঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন। দেশের সার্বিক রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি।
বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে আজ। ১৯৭৮ সালের এই দিনে (১ সেপ্টেম্বর) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এমন একটি সময়ে ৪৭ বছরে পা রাখছে, যখন দলটি শেখ হাসিনার আমলের জেল-জুলুম পেছনে ফেলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাধাহীন পথ চলছে। স্বপ্ন আবারো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার। দলটি পুরনো বৃত্ত ভেঙে রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়। বিশেষ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়ন হবে অন্যতম টার্গেট।
নেতারা বলছেন, গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং পরিবর্তনের এই পথটিও অনেক চ্যালেঞ্জের, কারণ ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আগামী দিনগুলোকে দলটির নেতারা তাই জোর দিচ্ছেন রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর।
যে পটভূমিতে যাত্রা বিএনপির
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে তিনি বিএনপি গঠন করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন প্রথম মহাসচিব।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই ছিল জিয়াউর রহমানের মূলমন্ত্র। এর ফলে দলটি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই সাফল্য পায়। খুব অল্প সময়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েন জিয়াউর রহমান।
ওইসময় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের মিশ্রণ বিএনপিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ‘রাজনৈতিক দর্শন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সেনা সদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতির হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনটিতেই বিএনপি জয়লাভ করে। তবে এক-এগারো সরকারের দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটি পরাজিত হয়।
পরবর্তী সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি। চরম বৈরী পরিবেশ সত্ত্বেও ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু মাত্র সাতটি আসন পায়। নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে অভিযোগ করে দলটি ওই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ওই নির্বাচনের এক বছর আগে কারাবন্দি হন বেগম খালেদা জিয়া। তখন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন তারেক রহমান।
আরও পড়ুন
সংঘাতে রক্তাক্ত বিএনপির তৃণমূল
এদিকে রাজনৈতিক পথচলার মাঝে তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলেও একাধিকবার প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে বিএনপিকে। বিশেষ করে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের সময়ে দলটির ওপর যে মামলা, হামলা, জেল, জুলুম শুরু হয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্বস্তি ফিরে বিএনপিতে।
দলটির তথ্য অনুযায়ী, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে এক লাখের ওপরে রাজনৈতিক মামলা দিয়েছিল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আসামি করা হয়েছিল ৩৫ লাখেরও বেশি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর বাইরে গুম হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।
নির্বাচনের বিকল্প ভাবছে না বিএনপি
এদিকে পরিস্থিতি যেমনই হোক বিএনপির লক্ষ্য এখন আগামী নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিকে ঘিরে দলটি নির্বাচনী কৌশল সাজাচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের নিয়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায় বিএনপি।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কারা হতে পারেন, সেটা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কাজ চলছে। এর অংশ হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে একাধিক জরিপও করা হয়েছে। কাকে কোথায় প্রার্থী করলে জিতে আসতে পারে, একইসঙ্গে ভালো ইমেজ আছে- এগুলো বিবেচনা করে প্রার্থী চূড়ান্ত করার চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রাথমিক বাছাই শেষ করবে দলটি বলে জানা গেছে। আর নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপি তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবে।
অবশ্য নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। যারা মনোনয়ন পেতে পারেন অথবা মনোনয়নপ্রত্যাশী, তারা নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তার করেছেন, গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। দল ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফাকেন্দ্রিক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বিএনপি মনে করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জের হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় বিভিন্ন ফোরাম এবং সাংগঠনিক কর্মসূচিতে একাধিকবার এ কথা বলেছেন। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
এদিকে ফুরফুরে মেজাজে থাকা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগের স্তুপ জমা হচ্ছে। তাই ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে ৫ আগস্টের পরে অপকর্মে জড়িত এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল ও অঙ্গ সংগঠনের চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ শাস্তিমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দিনে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায়ও সেটা বজায় রাখা হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। বিতর্কিত কাউকেই তিনি প্রার্থী করতে চান না। রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে তিনি গুণগত পরিবর্তন চান বলে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে জুলাই সনদের পাশাপাশি তারা তাদের ৩১ দফাও বাস্তবায়ন করে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবে। একইসাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকারও গঠন করবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা দাবি-দাওয়া এবং কিছুটা অস্থিরতা থাকলেও তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছে দলটি। নেতাদের বিশ্বাস, নির্বাচন হলে সকল সংকটের দ্রুত সমাধান হবে।
এদিকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দীর্ঘ দেড় দশক পরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ছাত্র-জনতার নিঃস্বার্থ আত্মদানের মধ্য দিয়ে গত বছর জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারী দানব আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। এখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গণতন্ত্রকামী দলগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।
কর্মসূচি: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শেরেবাংলা নগরস্থ সমাধিতে বিএনপি মহাসচিবসহ দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ, বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং আগামীকাল বেলা ২টায় দলের নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে দলীয় কার্যালয়ে ভোরে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটিকে সামনে রেখে পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
বিইউ/জেবি

