বিদায়ী মাসটি (জুলাই) সারাদেশ ঘুরেছে বৈষম্যবিরোধীদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দেশের ৬৪টি জেলাতেই ‘জুলাই পদযাত্রা’ নামে পথসভা করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু কতটা সফল হলো এনসিপির মাসব্যাপী এই কর্মসূচি?
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, গোপালগঞ্জে দলটির পথসভা ঘিরে সৃষ্ট ব্যাপক সহিংতা ও হতাহতের ঘটনা ইতিবাচক কোনো ফল দেয়নি। এছাড়া কক্সবাজারসহ কয়েকটি জায়গায় এনসিপি নেতাদের বক্তব্য ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করলে পণ্ড হয়ে যায় কর্মসূচি।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ৪৬ শিক্ষকের বিবৃতি
এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সুবিধা এবং বিভিন্ন বাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে কর্মসূচি পালনের অভিযোগও ওঠে তরুণ তুর্কিদের গঠিত দল এনসিপির বিরুদ্ধে।
যদিও দলটির নেতারা দাবি করছেন, সারাদেশে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন তারা। কিন্তু আসলেই কতটা সাড়া পেয়েছেন, সেই প্রশ্নে সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের।
বিজ্ঞাপন
এনসিপির কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা, নানা আলোচনার মধ্যেই গত বুধবার নরসিংদী ও সাভারে তাদের মাসব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয়। সেদিন দলটির কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন: আগামীর বাংলাদেশে এনসিপির জয়জয়কার হবে: নাহিদ ইসলাম
এর মধ্যে নরসিংদী পৌরসভা মোড়ে ত্রিমুখী রাস্তার সংযোগ সড়কে বেশ বড় একটি মঞ্চ বানানো হয়। মঞ্চের সামনে ছিল এনসিপির নেতাকর্মীদের ভিড়। তারা অপেক্ষা করছিলেন শীর্ষ নেতাদের জন্য। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ঘুরে বিকেলে এনসিপির পদযাত্রা যখন পৌঁছে যায় পৌরসভা মোড়ে, স্লোগানে মুখর ভিড় ঠেলে ঠেলে মঞ্চে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল নেতাদের।

একইদিন সাভারে পথসভার মাধ্যমে শেষ হয় পদযাত্রা। সারা দেশব্যাপী ও মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত এসব কর্মসূচিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা শুরু থেকেই অংশ নিয়েছেন।
পাঁচ মাস আগে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে একটি সমাবেশের মাধ্যমে এনসিপি যখন আত্মপ্রকাশ করে, তখন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই দলের ভবিষ্যত নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়।
আরও পড়ুন: ‘জুলাই সনদ মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে হলে তবেই স্বাক্ষর করবে এনসিপি’
বিশেষ করে রাজনীতিতে নতুন এসে এসব তরুণরা দেশব্যাপী সাংগঠনিক বিস্তৃতি এবং নতুন সমর্থকগোষ্ঠী কতটা তৈরি করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। জুলাই মাসব্যাপী দেশজুড়ে পদযাত্রাকে এখন সেই প্রশ্নেরই উত্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করছে এনসিপি।

বিবিসির বাংলার সঙ্গে আলাপকালে এ ব্যাপারে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা দাবি করেন, এই পদযাত্রায় সাধারণ মানুষের কাছ তারা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পেয়েছেন।
তার কথায়, ‘আমরা মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমরা মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করেছি। যেসব সমস্যা পেয়েছি সেগুলোকে ঘিরেই আমাদের রাজনীতি হবে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই রাজনীতিকে এগিয়ে নেব আমরা।’
আরও পড়ুন: এনসিপির অনুরোধে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করল ছাত্রদল
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দাবি, ‘এনসিপি গণমানুষের দল হয়ে উঠছে। আমাদের পথসভাগুলো জনসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক জায়গায় জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। যেখানে আমাদের সাংগঠনিক লোক নেই, সেখানেও সাধারণ মানুষ কিংবা উৎসুক জনতা কর্মসূচিতে এসেছে, সমর্থন দিয়েছে।’

এনসিপির নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা যেমন তরুণ তেমনই ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে দলটির যে সাংগঠনিক তৎপরতা, সেটাও মূলত শহরকেন্দ্রিক। যেসব বড় কর্মসূচি তারা পালন করেছে, সেগুলোও সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকার ভেতরে।
ফলে তৃণমূলে এনসিপির সাংগঠনিক বিস্তৃতি কীভাবে হবে, কিংবা দলটি কতটা গণমানুষের দল হয়ে উঠবে- সেটা ছিল বড় প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চাইল এনসিপি
এ ব্যাপারে নাহিদ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা ছিলাম ছাত্রনেতা। আমাদের আন্দোলন কিংবা রাজনীতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক। সেখান থেকে এখন আমরা গণমানুষের যে নেতৃত্ব, সে জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। মানুষের কাছাকাছি আমরা যেতে পেরেছি।’

তিনি বলেন, ‘এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারাদেশের মানুষকে আমরা কানেক্ট করেছি। গণঅভ্যুত্থানের সময় আমাদের যে স্লোগান ছিল– ‘তুমি কে আমি কে; বিকল্প, বিকল্প’ সেই বিকল্প নেতৃত্ব মানুষ দেখতে পাচ্ছে।’
এদিকে এনসিপির দুটি সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, নাহিদ ইসলাম, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, তাসনিম জারা, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ কিংবা সামান্থা শারমিনদের মতো কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘিরে দলের কর্মীসহ সাধারণ মানুষের বেশ আগ্রহ। ফলে দলটির পদযাত্রা কিংবা সমাবেশগুলোতে জমায়েতও হয়েছে ভালো।
আরও পড়ুন: জুলাই সনদের জন্য ৫ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এনসিপি
আবার একইসঙ্গে কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যপক তৎপরতাও চোখে পড়েছে। সমাবেশস্থল তো বটেই, মিছিলের সামনে-পেছনে এবং গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতেও নিরাপত্তা সুবিধা দিতে দেখা গেছে পুলিশকে।

সব মিলিয়ে ‘সরকারি সুবিধা নিয়ে কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি’–– এমন আলোচনাও আছে।
এ ব্যাপারে নাহিদ ইসলাম দাবি করছেন, তারা সরকারের কাছে কোনো বাড়তি সুবিধা চাননি।
আরও পড়ুন: ‘হয় আওয়ামী লীগ থাকবে না হয় এনসিপি থাকবে, দুইটা একসঙ্গে চলতে পারে না’
তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারি দলের সুবিধা পেলে গোপালগঞ্জে আমাদের জীবন হুমকিতে পড়তো না। সেখানে যে হামলা হলো, সেটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়ে গিয়েছিল। আমরা সবখানে বলেছি, আমাদের অতিরিক্ত কোনো প্রশাসনিক নিরাপত্তা দরকার নেই।’

এনসিপি এই পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে কতটা গণসম্পৃক্ত হতে পারল দলটি– এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, গণসম্পৃক্ততা বা সমর্থন বুঝতে হলে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন: রাজনীতিতে এনসিপির নীতি-আদর্শ কী হবে, জানালেন নাহিদ ইসলাম
তিনি বলেন, ‘শুরু থেকে যদি তারা (এনসিপি) পরস্পরবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি না দিতো, কাউকে মৌখিকভাবে আক্রমণ না করতো, তাহলে আমার মনে হয় এই দলের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। এখন তাদের জনভিত্তি যে শুধু পদযাত্রার ওপর নির্ভর করবে তা নয়। তারা কী করতে চায়, সেটা কিন্তু মানুষের কাছে এখনো সেভাবে পৌঁছায়নি।’
ড. সাব্বির আহমেদ এটাও মনে করেন, দল হিসেবে প্রাথমিক যে পরিচিতি দরকার, এনসিপি সেটা করতে পেরেছে। তারা মানুষের কাছে গিয়েছে, দলের পরিচিতিটা হয়ে গেছে। আপাতত এটাই তাদের একটা অর্জন।’
এএইচ

