রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘ছোট’ হয়ে আসছে জিএম কাদেরের বলয়!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৫, ১১:১৫ এএম

শেয়ার করুন:

‘ছোট’ হয়ে আসছে জিএম কাদেরের বলয়!
  • অব্যাহতি পাওয়াদের বলয়ে ঝুঁকছেন জাপার প্রভাবশালী নেতারা
  • কাদেরের ক্ষমতা কমাতে শুরু হচ্ছে আইনি লড়াই  
  • দল ছাড়া নেতাদেরও কাছে টানছেন আনিসুল-হাওলাদাররা
  • পাত্তা দিচ্ছেন না জাপার নতুন মহাসচিব

সম্মেলন ডাকার পাশাপাশি চেয়ারম্যান-মহাসচিব পদে দলের ভেতর থেকে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশকে কেন্দ্র করে এবার অস্থিরতা শুরু হয়েছে জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। শীর্ষ নেতাদের একের পর এক অব্যাহতি দেওয়ায় তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। আরও অনেককে বাদ দেওয়া হতে পারে এমন গুঞ্জনও আছে। দলীয় প্রধান জিএম কাদের একক সিদ্ধান্তে এমনটা করলেও মানতে নারাজ অব্যাহতি পাওয়া নেতারা। সম্মেলন ডেকে আগামী দিনে দলের নেতৃত্ব ঠিক করার পাশাপাশি এই নেতারা গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে দেওয়া সর্বময় ক্ষমতার ধারা বাতিলের জন্য আদালতের আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবছেন। শিগগিরই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হতে পারে বলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন


পাশাপাশি দলে কোনঠাসা হয়ে থাকা সাবেক মন্ত্রী-এমপি, এলাকায় প্রভাবশালী নেতাদেরও কাছে টানার চেষ্টা করছেন অব্যাহতি পাওয়া নেতারা। বিভিন্ন সময় দল ছেড়ে যাওয়া নেতাদের সঙ্গেও বাড়ানো হচ্ছে যোগাযোগ।

অন্যদিকে জিএম কাদের বলয়ের নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল চলবে। এখানে কারও ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধা দেখার সুযোগ নেই। দলের শৃঙ্খলা যে ভাঙবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আর সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে যেসব নেতাদের নিয়ে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা বলয় শক্তিশালী করার চিন্তা করছেন তা গায়ে মাখছেন না জিএম কাদের বলয়ের নেতারা।

এদিকে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার আগে থেকেই অনেকটা আড়ালে চলে গেছেন জিএম কাদের। গত সোমবার (০৭ জুলাই) একযোগে মহাসচিব পদে রদবদলের পর শীর্ষ তিন নেতাকে অব্যাহতি দেন তিনি। গুঞ্জন ছিল নীরবতা ভেঙে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন এরশাদের ছোট ভাই। কিন্তু এখনো তিনি কোথাও কথা বলছেন না।


বিজ্ঞাপন


দেখা গেছে, নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেওয়া শামীম হায়দার পাটোয়ারী, কো চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ছাড়া এই মুহূর্তে প্রভাবশালী কোনো নেতাকে জিএম কাদেরের বলয়ে দেখা যাচ্ছে না।

5

অন্যদিকে অব্যাহতি পাওয়া আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হকদের সঙ্গে প্রভাবশালী অনেকে একত্রিত হয়েছেন। সামনে জাতীয় পার্টি ছেড়ে যাওয়া অনেকে ভিড়তে পারেন আনিসুল-হাওলাদারদের বললে। ফলে ক্রমেই চাপ বাড়তে পারে জিএম কাদেরের ওপর।

অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের আয়োজনে গুলশানে রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন হয়। যেখানে ১৬ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের চার উপদেষ্টা, দুই যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ২১ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।

তবে দলের ভাঙন সৃষ্টি না করে কিভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় সেটাই প্রথম বিবেচনায় রাখছেন আনিসুল ইসলামরা।

জাতীয় পার্টি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ধারা ২০ এর উপধারা (১) /ক এর ক্ষমতা প্রয়োগ করে যা খুশি তাই করছেন। অগণতান্ত্রিক আচরণ করছেন। আমরা এটার বিরোধীতা করে আসছি। এই সুযোগ তাকে আর দিতে চাই না। আমরা আদালতের আশ্রয় নেব।’ 

কবে নাগাদ আদালতে যাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরই আমরা কোর্টে যাবো।’

অবশ্য জিএম কাদেরপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুরের সাবেক সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা আদালতে যাওয়ার বিষয়কে আমলে নিচ্ছেন না। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের নেতারা জিএম কাদেরের সঙ্গে আছেন। কিছু নেতা চলে গেলে দলের কোনো ক্ষতি হবে না।’

দলটির নবনিযুক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিগত দিনেও কিছু সিনিয়র নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় পার্টির সঙ্গে বেইমানি করেছিল। এ কারণেই জাতীয় পার্টি সাতবার ভেঙেছে। কিন্তু জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সব সময় পার্টির সঙ্গে ছিল, তৃণমূল নেতা-কর্মীরা কখনোই জাতীয় পার্টির মূলস্রোতের বাইরে যায়নি।’

এদিকে এমন পরিস্থিতিতে আসছে নির্বাচনের আগে আবারও জাপায় ভাঙন দেখা দেবে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। তবে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা ভাঙন নয়, সবাইকে নিয়ে চলায় জোর দিচ্ছেন। 

এই নেতারা বলছেন, তারা জাতীয় পার্টিতেই থাকবেন। দলকেও ভাঙতে দেবেন না। কাউন্সিল করে সেখানে নতুন নেতৃত্ব বাছাই করা হবে।

জানা গেছে, ১৪ জুলাই প্রয়াত চেয়ারম্যানের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাপার সাবেক-বর্তমান নেতাদের এক ছাদের নিচে দেখার সম্ভাবনা আছে।

4
জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অভিযোগ করলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

নেতারা বলছেন, জাতীয় পার্টিতে অনেকটা একনায়কতন্ত্র বিরাজ করছে। তাই তারা গঠনতন্ত্রের ২০ এর উপধারা (১) /ক এর প্রয়োগ বন্ধ করতে চান তারা। অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টির সবার মতামত ও নেতৃত্বে চলবে সেটা তারা চাচ্ছেন। যে কারণে ধারাটি বাতিলের জন্য আদালতের দারস্থ হওয়ার চিন্তা করছেন।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘নিশ্চিত থাকুন এই ধারা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে আমরাই জয়ী হবো। কারণ কোনোভাবেই এই ধারা চলতে পারে না। এই ধারা বাদ দিলে একক ক্ষমতা চলে যাবে সে কারণেই চেয়ারম্যান যাকে খুশি বাদ দিচ্ছেন।’

যে কারণে অস্থিরতা 

এবার জাতীয় পার্টিতে দলের জাতীয় সম্মেলন এবং এতে চেয়ারম্যান-মহাসচিব পদে অন্যদের প্রার্থী হওয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা শুরু হয়। গত ৭ জুলাই হঠাৎ করে মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে সরানোর সিদ্ধান্তের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। শুধু তাই নয়, চুন্নুর বদলে এই পদে শামীম হায়দার পাটোয়ারিকে মহাসচিব করার পর দলের জ্যেষ্ঠ তিন নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হককে (চুন্নু) দলীয় সব পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। 

দ্রুততার সঙ্গে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের এমন সিদ্ধান্তে অব্যাহতি পাওয়া নেতারাও আশ্চর্য হয়ে যান।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা বেআইনি। আমরা সবাই আগের পদেই আছি। ২৮ তারিখের বৈঠকে তো কোরামই হয়নি। কিভাবে সেই বৈঠক এমন সিদ্ধান্ত নেয়।’

এদিকে এই তিন নেতার বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে আরও আটজন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

6
দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানান জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের এক প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত ধরে যাদের মাসিক চাঁদা এক বছর বকেয়া তাদের পদ চলে যাবে সেই সিদ্ধান্তের কারণে এই নেতারা বাদ পড়েছেন।

আনিসুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, এতবছর ধরে দল করছে মানুষগুলো, প্রত্যেকের কত অবদান। এরা কি চাঁদা পরিশোধের সামর্থ্য রাখে না? রিমাইন্ডার দিতে পারত।

তিনি উল্টো জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, আগের বৈঠকে চেয়ারম্যানের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি মনোনয়নের কোটি কোটি টাকা দলের ফান্ডে জমা দেননি। এসব নিয়ে কথা বলায় ভালো লাগেনি। আমরা ২০–এর ১/ (ক) ধারাটি বদলানোর কথা বলেছি। সেটা তিনি মানবেন না। নিজে রাজার মতো থাকবেন এটা তো হতে পারে না। এটাই বড় কারণ।

বারবার ভাঙনের কবলে জাপা

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতেগড়া দল জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। এরশাদের জীবদ্দশায় জাপা, জেপি, বিজেপি ও জাপা (জাফর) নামে চার টুকরো হয়ে যায়। 

তার মৃত্যুর পর সহধর্মিণী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি জাপার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও রওশন গ্রুপের তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। মাঝে মধ্যে বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ওই গ্রুপটির কার্যক্রম। 

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর