সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আরও হতাশায় আ.লীগের তৃণমূল, দীর্ঘ হচ্ছে ফেরার পথ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ মে ২০২৫, ১০:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

আরও হতাশায় আ.লীগের তৃণমূল, দীর্ঘ হচ্ছে ফেরার পথ
ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। ছবি: ঢাকা মেইল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রায় নয় মাস আগে যখন ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ তখন ব্যাপক রোষানলে পড়েন দলটির নেতাকর্মীরা। পদধারী নেতা থেকে শুরু করে কর্মী-সমর্থকদের বেশির ভাগই হতে হয় এলাকাছাড়া কিংবা বাড়িছাড়া। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় দলটির নেতাকর্মীরা লুকিয়ে-ছাপিয়ে ঝটিকা মিছিলও শুরু করেছিলেন। ভার্চুয়ালি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে বসে নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধও করছিলেন নানাভাবে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আশা ছিল, পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে এবং তারা প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন। কিন্তু এবার দলটির সবধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন স্থগিত করায় চরমভাবে হতাশ হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার ক্ষীণ আশাও আর নেই তাদের সামনে।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন বাতিলের পর কয়েকটি জেলার আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কণ্ঠে হতাশার সুর লক্ষ্য করা গেছে। তারা বলছেন, এতদিন তাদের ধারণা ছিল, আগামী কয়েক মাস পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে তারা স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন। নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় দল হিসেবে তাদের আর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। এতে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও আপাতত তারা দেখছেন না।


বিজ্ঞাপন


দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার আওয়ামী লীগের একজন কর্মী অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘কিছু লোকের কারণে আজ দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী সংকটে। শুরুতেই আমাদের উচিত ছিল, দেশবাসীর কাছে অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। কিন্তু আমাদের নেতারা তো কোনো দায়ই স্বীকার করেননি। দেশের মানুষ এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। এজন্য আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন বাতিল হলেও একটা মিছিলও হয়নি কোথাও।’

88
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ছবি: ঢাকা মেইল

একটি জেলার পদধারী একজন নেতা বলেন, ‘এতদিন আমাদের বলা হচ্ছিল, আর কিছু দিন এভাবে কাটালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ভারতের সহযোগিতায় আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবো বলেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু এখন তো দেখি এসব আশ্বাস ছিল ভুয়া। এখন তো আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মামলার বোঝা নিয়ে নানা স্থানে গা ঢাকা দিয়ে আছি। এভাবে আর কতদিন থাকতে পারবো জানি না।’


বিজ্ঞাপন


রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগেও বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সংকটে পড়েছে, দলটির নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে। তবে এবারের মতো এই পর্যায়ের সংকটে কখনো পড়েনি আওয়ামী লীগ। এত বিশাল দল, এত নেতাকর্মী থাকা সত্ত্বেও দলটি গত নয় মাসেও প্রকাশ্যে কোনো কর্মকাণ্ড করতে পারছে না। আর এখন যেহেতু সরকারিভাবে কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধনও বাতিল, সুতরাং আপাতত আওয়ামী লীগের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক সরকার এলে এবং পরিস্থিতির পাল্টালে দলটি এক সময় ঘুরে দাঁড়াতেও পারে।

আরও পড়ুন

আজও ‘কঙ্কালসার’ আওয়ামী লীগের তিন কার্যালয়

গত কয়েক মাস ধরে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যে করেননি এমন নয়। এমনকি হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও দিয়েছে দলটি। তবে তৃণমূলের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। যেহেতু নেতাদের বেশির ভাগেই পালিয়ে আছেন, কেউ জেলে কেউ বিদেশে, দলটির মূল সংকট নেতৃত্ব। সামনে এসে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ আওয়ামী লীগে নেই। এটাই দলটির বড় সংকট হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

কিছু দিন আগে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল শুরু হয়েছিল। দিন দিন সেই মিছিলে লোকসংখ্যা বাড়ছিল। বিষয়টিকে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার আভাস হিসেবে দেখছিলেন অনেকে। বিরোধীদের মধ্যে একটা উদ্বেগ ও আতঙ্কও দেখা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও কিছুটা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু এরপর সরকারের ধড়পাকড় বেড়ে যাওয়ায় তারা চাপে পড়ে। মিছিলে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের ছবি দেখে দেখে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরপর নির্বাচন কমিশনও নিবন্ধন স্থগিত করে। এতে আরেক দফা বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ।

dhaka
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ছবি: ঢাকা মেইল

সরকারের এবারের পদক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগ অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। বিদেশে থাকা নেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, এই সরকার ‘অবৈধ’, এজন্য সরকারের সিদ্ধান্তও ‘অবৈধ’। যদিও দেশে থাকা নেতাকর্মীদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। এত বড় সিদ্ধান্তে তারা প্রতিক্রিয়া জানাবে- এমনটা ধারণা করা হচ্ছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সে ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু আগে কিছু ঝটিকা মিছিল হলেও দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিতের পর কোথাও কোনো প্রতিবাদের খবর পাওয়া যায়নি। যেহেতু অনলাইন প্লাটফর্মেও কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে, এজন্য দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনলাইনেও তেমন প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের তৃণমূল হতাশ হয়ে পড়েছে। তারা ধরে নিয়েছে, আপাতত দল ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো ‍সুযোগ নেই। এজন্য তারা প্রকাশ্যে এসে বা কোনো কর্মসূচি পালন করে বিপদে পড়তে চাচ্ছে না। তাদের বক্তব্য হলো, দল সংকটে পড়েছে নেতাদের কারণে। এবার নেতারা রাস্তায় নামুক। নেতারা লুকিয়ে থেকে কিংবা বিদেশে বসে নির্দেশনা দিলে সেই নির্দেশনা মেনে আমরা বিপদে পড়তে যাবো না।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে ভারতের উদ্বেগ

আওয়ামী লীগের হতাশ হয়ে পড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম। সরকার এই বিচার প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই অবস্থায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ সারির অনেক নেতার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হয়ে যাবে। শত শত হত্যা মামলায় দণ্ডিত হবে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা। এতে আগামী দিনে দলটি আরও বেশি নেতৃত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ একদম শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো দুই ধারায়- মোটাদাগে যার একটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আর অপরটির নেতৃত্বে বিএনপি। দল হিসেবে ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের। এখন তারা তাদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসার চেষ্টা যখন করবে, তখন রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে।

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর