সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিপদ ‘বাড়াচ্ছে’ জাপা!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ এএম

শেয়ার করুন:

বিপদ ‘বাড়াচ্ছে’ জাপা!

বিগত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। এজন্য বিএনপিসহ অন্যান্য দল এরশাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত দলটিকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ আখ্যা দিয়ে আসছিল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দলটির পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও বেকায়দায় পড়ে। শুরুর দিকে আওয়ামী লীগকে ‘ক্ষমতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়া’ জাতীয় পার্টির প্রতি কারও তেমন নজর না পড়লেও কিছুদিন গড়াতেই ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে জাতীয় পার্টির নামও সামনে আসতে থাকে নানা মহল থেকে। অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘দোসর’ খ্যাতি পাওয়া জাপা নেতাদেরও বিচারের দাবি করছেন।

ইতোমধ্যে হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও তার স্ত্রী শরিফা কাদের। দলের মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুও পড়েছেন মামলার কবলে। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা গ্রেফতার হলেও এখনো নিরাপদে আছেন জাপা নেতারা। সবার মধ্যে আছে গ্রেফতার আতঙ্ক।

গত অক্টোবরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের হুমকি, অবাঞ্ছিত ঘোষণার পর চাপ বাড়ে জাপার ওপর। সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে দলের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেওয়ায় বিপদ আরও ঘনিয়ে আসছে এমন গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মামলা থাকা নেতারা গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। এরইমধ্যে জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রতিবাদের মুখে আমন্ত্রণ পায়নি জাপা।

আরও পড়ুন

কোন পথে জাতীয় পার্টির রাজনীতি?

অবশ্য বিপদের ‍মুখে পড়তে হতে পারে এমন আশঙ্কা আগেই ছিল জাতীয় পার্টিতে। যে কারণে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর কিছুদিন অনেকটা নীরব ছিলেন জিএম কাদেরসহ অন্যান্য নেতারা। যদিও চুপ থেকে মামলার হাত থেকে রক্ষা পাননি জিএম কাদের দম্পতি, জাপা মহাসচিবসহ আরও একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো তাদের কেউ কেউ চলে গেছেন আত্মগোপনে।


বিজ্ঞাপন


আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ইস্যু ও জাপাকে বাদ দিয়ে সরকারের জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়- জিএম কাদেরের এমন বক্তব্য দলটির আরও বিপদ বাড়াতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। এরইমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সাফ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘জাতীয় পার্টি হলো জাতীয় বেইমান। স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে আর কোনোদিন প্রাসঙ্গিক না এবং প্রাসঙ্গিক হবেও না।’

japa_2
গত ৩১ অক্টোবর কাকরাইলে অবস্থিত জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়।

সম্প্রতি কুমিল্লায় দেওয়া এক বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেওয়ারও ইঙ্গিতও দিয়েছেন হাসনাত। বলেছেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগই নয়, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ১৪ দলের কোনো নেতাকর্মীকে ডামি-আমি ও স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।’

একই সূরে কথা বলেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানও। গত শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) ঝিনাইদহে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের দোসররা কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।’

আরও পড়ুন

আ.লীগ-জাপা ছাড়া জাতীয় ঐক্য টিকবে না: মোস্তফা

রাজপথে যখন এমন হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে তখন জাপা নেতারাও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেদিকে নজর রাখছে দলটি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

সবশেষ গতকাল সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জিএম কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোট নিয়ে সব দল যখন একদিকে, তখন দফায় দফায় নির্বাচনে গিয়ে সুবিধা নিয়েছে জাতীয় পার্টি। ভোটে গিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসায় সাধারণ মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে দলটি। নতুন পরিস্থিতিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা জাপাকে চাপে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

Japa2নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক জাপার অনেক নেতার কণ্ঠেও বিপদ বাড়ার শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আমন্ত্রণ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দাওয়াত না দিলে কীভাবে যাব। আগে দাওয়াত পেয়েছিলাম। এখন পাইনি। তাই ইচ্ছা থাকলেও যাওয়ার সুযোগ নেই।’

বিদ্যমান অবস্থায় জাতীয় পার্টি কতটা স্বস্তিতে আছে- এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যান জাপা মহাসচিব। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন কো-চেয়ারম্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শক্তিধর আওয়ামী লীগই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে সেখানে আমাদের ওপর ঝড় যাবে এই ধারণা তো আছেই। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি ভালো হলেও সামনে কী হবে তা তো কেউ বলতে পারছে না। সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।’

যেভাবে বিপদ ‘বাড়াচ্ছে’ জাপা

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর শুরুর দিকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জাতীয় পার্টি ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তাদের অভিযোগ, দলটির নীতিনির্ধারণ, ভারতঘেঁষা রাজনীতি এবং ভোটবিহীন সরকার ব্যবস্থা চালু রাখতে জাতীয় পার্টি সবসময় আওয়ামী লীগকে সহায়তা করেছে।

পরবর্তীতে দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যাতে অংশ নেয় জাতীয় পার্টিও। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। ফেসবুক পোস্টে তারা জাতীয় পার্টিকে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের দোসর ও মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালাল বললে জাপার নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এমন বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে রংপুরে প্রবেশ করতে না দেওয়ারও ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটির সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তাদের প্রতিহত করতে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দেন মোস্তফা।

আরও পড়ুন

সংলাপে ডাক না পেয়ে ‘হতাশ’ জাপা

পরবর্তীতে গত ২৫ অক্টোবর এই দুই সমন্বয়কের আসার খবরে রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল করে জাপার নেতাকর্মীরা। সেখানে তাদের দুজনকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয়।

এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দেয়। পরবর্তীতে পূর্বনির্ধারিত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সারজিস আলম গেলেও হাসনাত আবদুল্লাহ যাননি।

রংপুরের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ঢাকায় কাকরাইলের কার্যালয়ের সামনে জাপার পক্ষ থেকে কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরআগেই সেখানে গত ১ নভেম্বর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আগুন দেওয়া হয় জাপা কার্যালয়ে। এ নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও পরবর্তীতে আরও বেশি দূর এগোতে পারেনি।

আরও পড়ুন

আ.লীগ-জাপা ও তাদের দোসররা রাজনীতি করতে পারবে না: রাশেদ

ওই ঘটনার পর কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও গত সপ্তাহে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় মৃদু ক্ষোভ দেখা দেয় জাপায়। সরকারের জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘মাত্র ১৮টি দলকে নিয়ে তারা জাতীয় ঐক্য করেছে। অথচ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল ৫৩টি। ৫০ শতাংশ মানুষকে জাতীয় ঐক্যের বাইরে রাখা হয়েছে।’

শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগকে সরকার নিষিদ্ধ করতে পারে না এমন দাবি করে আগামী নির্বাচনে অবশ্যই দলটির অংশ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জিএম কাদের।

জাপা চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যে ফুঁসে উঠেছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। তিনি এমন বক্তব্য দেওয়ার সাহস কীভাবে পান সেই প্রশ্নও তুলেছেন এসব দলের নেতারা।

বিইউ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর