ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে দেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের মিত্র দল জাতীয় পার্টি। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রায় আড়াই মাস পর জাপার কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্র-জনতার ব্যাপারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর শনিবার কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিরোধের ঘোষণার পর ওই এলাকায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। যে কারণে জাতীয় পার্টি তাদের কর্মসূচিও স্থগিত করে। এমন অবস্থায় বড় ধরনের চাপে পড়া জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত রাজনীতি করতে পারবে কি-না, তা নিয়ে চিন্তিত দলের নেতারা।
প্রধান উপদেষ্টার দফতর জানিয়েছে, দেশে এখনও কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি৷ কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও শ্রমিক আন্দোলন ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের' সহযোগী হিসাবে দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে৷ আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘‘আমরা মনে করি নিষিদ্ধ হবে বিচারের মাধ্যমে৷ তবে তার আগে আমরা জাতীয় পার্টির কার্যক্রম স্থগিত করার দাবি জানিয়েছি সরকারের কাছে।’
জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ‘হামলাকে আমরা সমর্থন করি না৷ তবে ফেসবুক পোস্ট দিয়ে যে সমন্বয়কেরা গেছেন, সেটা আমাদের আন্দোলনেরই অংশ৷ তারা স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল৷ তাই ঘেরাও করা আন্দোলনেরই অংশ৷ আমরা আগুন বা হামলা সমর্থন করি না৷ তবে ওই হামলা ও আগুনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই৷ কারণ তারা গেছে রাত সাড়ে ৮টার পরে৷ তার আগেই হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘‘জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে কি-না, তা দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে৷ তাদের বিচার হবে৷ তবে বিচার শেষ হওয়ার আগে আমরা তাদের দলের কার্যক্রম স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছি সরকারের কাছে।’
আর প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার জানান, ‘কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেই৷ কোনো দলকে নিষিদ্ধও করা হয়নি৷ একটি ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জাতীয় পার্টি একটি স্বৈরাচারি দল৷ তাদের জন্ম স্বৈরাচারি কায়দায়৷ আর তারা স্বৈরাচারকে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে৷ এই দলটি সম্পর্কে দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা রাজনীতি করতে পারবে কি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আর আমাদের সংবিধানে সভা-সমাবেশ করার অধিকার দেওয়া আছে৷ জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে৷ তার মানে এই নয় যে, কোনো একটি দলকে নিষিদ্ধ করা হবে বা তার রাজনীতি করার অধিকার নেই।’
আরও পড়ুন
জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা ও আগুন প্রসঙ্গে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এটা তো একটা ফ্যাসিবাদি আক্রমণ৷ যে ঘোষণা করে, ঘটা করে একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে আক্রমণ এবং আগুন দেওয়া হয়েছে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমরা মনে করি, আমরা যে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আছি এর মাধ্যমে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
গণ অধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা কোনো ধরনের হামলা, সহিংসতা ও মব জাস্টিসকে সমর্থন করি না৷ আমরা মনে করি, এখন একটা সরকার আছে৷ সেই অবস্থায় যদি এরকম করা হয় তাহলে দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা হবে৷ আর জাতীয় পার্টি অফিসে কারা হামলা করেছে, নিজেরাই করেছে কি-না তার তদন্ত হওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘তবে যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর এবং সহযোগী ছিলো তাদের নিষিদ্ধের দাবি জানাই আমরা।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় এক আলোচনায় বলেছেন, ‘দেশের কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি৷ দেশে অযথা ইস্যু তৈরি করে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে৷ বাংলাদেশকে ঘিরে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে৷ এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দেশের জনগণকে সজাগ থাকতে হবে।’
আর কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ভাঙচুর থেকে বিরত থাকতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সব দলকে আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী৷
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে আমি কোনো বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক দল মনে করি না৷ স্বৈরাচারী উপায়ে এর জন্ম হয়েছে৷ পরে স্বৈরাচারের সহযোগী হয়েছে৷ আর আসলে তাদের কার্যালয়ে হামলা না বলে আমি দুই পক্ষের সংঘর্ষ বলব৷ আর এতে জাতীয় পার্টির উস্কানি ছিল৷ আমি মনে করি, পুলিশ প্রশাসন শনিবার তাদের সমাবেশ করতে না দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
কী ভাবছে জাতীয় পার্টি?
জাতীয় পার্টি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে দাওয়াত পেলেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কোনো সংলাপেই তাদের ডাকা হয়নি৷ আওয়ামী লীগের সহযোগী ১৩ দলও ডাক পায়নি৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল৷
কয়েকদিন আগে রংপুরে দুই সমন্বয়কের সফরের সময় প্রতিরোধের ডাক দেয় জাতীয় পার্টি৷ এরপর তারা ঢাকায় শনিবারের সমাবেশের কর্মসূচি দিলে বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটে৷ তারপরও তারা শনিবার সমাবেশের ব্যাপারে অনড় ছিল৷ কিন্তু পুলিশের নিষেধাজ্ঞার পর তারা সমাবেশ বাতিল করে৷
এ প্রসঙ্গে আইনের প্রতি শ্রদ্ধার কথা বললেও আসলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতা৷ তারা বলেন, ‘হামলার প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে তারা পরের অবস্থান নেবেন।’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পটোয়ারী বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি, এই কারণে আমাদের নিষিদ্ধ করা হবে ছাত্রদের দাবীর মুখে তা হতে পারে না৷ সংবিধান এবং আইনে কারা সংগঠন করতে পারবে এবং দল করতে পারবে তা স্পষ্ট বলা আছে৷ সন্ত্রাসী কাজের জন্য, জঙ্গি তৎপরতার জন্য নিষিদ্ধ করা যায়৷ জাতীয় পার্টি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘আমাদের দলীয় কার্যালয়ে হামলার সময় পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিরোধে যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তা রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল৷ মামলা করার জন্য আমাদের লোক গেছে। কিন্তু এখনও পুলিশ মামলা নেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হয়েছে৷ সুতরাং কারা হামলা করেছে তা স্পষ্ট৷ সরকার চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘‘জাতীয় পার্টি তার গণতান্ত্রিক রাজনীতি অব্যাহত রাখবে৷ ঘোষণা দিয়ে হামলা, রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে৷ কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।’ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।
এমআর

