এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিল সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে নানা নাটকীয়তার পর নির্বাচনে আসা দলটির প্রার্থীদের অনেকেই এখন নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সংখ্যাটা তত লম্বা হচ্ছে। দলীয় সূত্রমতে— এখন পর্যন্ত ২৪ আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। প্রশ্ন উঠছে- কেন নির্বাচনের খুব কাছে এসেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করছেন জাপার প্রার্থীরা?
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা, দলের কেন্দ্রীয় সমন্বহীনতা, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা, সংঘর্ষ-সংঘাত ও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী। তাদের মধ্যে- গাজীপুর-১, গাজীপুর-৫, বরিশাল-২, বরিশাল-৫, বরগুনা-১, হবিগঞ্জ-২, সিরাজগঞ্জ-৩, নাটোর-৪, চুয়াডাঙ্গা-১, দিনাজপুর-২, গাজীপুর-৪ ও সুনামগঞ্জ-১ আসন অন্যতম।
বিজ্ঞাপন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া আগে জাতীয় পার্টি জানিয়েছিল, এবার তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। তবে শেষ পর্যন্ত ২৮৭টি আসনে দলীয় পার্টি ঘোষণা করে জাপা। পরবর্তী সময়ে ২৬টি আসনে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়। তবে বাকি আসনগুলোতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রাখে দলটি। তবে সমঝোতার বাইরের আসনগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের তথ্য পাওয়া গেছে। যারা আছেন, তাদেরও অনেকেই নির্বাচনী প্রচারে তেমন জোর দিচ্ছেন না। ফলে শুধু প্রার্থী নয়, সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৬টি আসনে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্তের কারণে বাকি আসনগুলোর প্রার্থীদের মধ্যে ‘অবহেলিত’ মনোভাব তৈরি হয়েছে। ফলে কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে এবং এই দূরত্ব নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্তির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞাপন
কী বলছেন প্রার্থীরা?
বরিশাল-২ ও বরিশাল-৫ আসনে জাপার প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর মুখে বললেও তাদের আচরণে মনে হচ্ছে তারা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। সরকার কিছু রাজনৈতিক দলকে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে ৭ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যে নির্বাচনে সাধারণ মানুষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। নির্বাচনে রয়েছে একটি দল আর সেই দলের লেজুড়ভিত্তিক কিছু মানুষ, তারাই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করায় সাধারণ ভোটাররা জাপা প্রার্থীদের বিশ্বাস করছেন না বলে জানিয়েছেন বরগুনা-১ আসনের লাঙ্গলের প্রার্থী খলিলুর রহমান। তিনি বলেছেন, আসন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করায় আমরা ভোটারদের সামনে যেতে পারছি না। তারা আমাদের বিশ্বাস করে না। এছাড়া নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই বলেও মন্তব্য করেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা এই জাপা নেতা।
হবিগঞ্জ-২ আসনে (বানিয়াচং-আজমিরিগঞ্জ) জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন শংকর পাল। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব রয়েছে। আছে ক্ষমতাসীনদের পেশীশক্তির প্রভাব। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে সংঘর্ষ-সংঘাত চলছে, তাতে নিজের ও সমর্থকদের জানমাল রক্ষা করা কঠিন। গত নির্বাচনে আমার এজেন্টকে নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। কারণ ছাড়াই দোকান থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এর জবাব আজও পাইনি। এবারের নির্বাচনেও যে তা হবে না, এর নিশ্চিয়তা কোথায়?’
দিনাজপুর-২ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী মাহবুব আলম জানান, আসন্ন নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে তার সংশয় রয়েছে। তাই তিনি নির্বাচনী সব প্রচার-প্রচারণা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
গাজীপুর-৪ আসনের জাপা প্রার্থী মো. সামসুদ্দিন খান বলেন, ‘দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। কাপাসিয়া আসনে আমি দলীয় লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করার প্রস্তুতিও নিয়েছি। বর্তমানে শারীরিক ও পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি।’
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী জানান, গত বুধবার থেকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত আছি। কেননা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের টাকার পাল্লার কাছে নির্বাচন করার মতো আমার অবস্থা নেই। দল থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে অসহযোগিতার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ফোন করলে চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব ধরেন না। কেন্দ্রে যারা আছেন তারা কেউ সহযোগিতা করছেন না। সারাদেশে জাতীয় পার্টির ৩৮৩ জনের মধ্যে সরকারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ২৬ জনকে উনারা আসন দিয়েছেন। আমাদের সকল দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কারণ কী দেখছে জাপা?
দলীয় প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের টাকা খরচের বিষয়টিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি। জাপা মহাসচিব বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সারাদেশে প্রচুর টাকা খরচ করছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জাতীয় পার্টির কিছু কিছু প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
দলীয়ভাবে প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সারাদেশে জাতীয় পার্টি অনেক প্রার্থী দিয়েছে। তাদের সবার অবস্থা সমান নয়। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচুর টাকা খরচ করছেন। আমরা কেন্দ্র থেকে প্রার্থীদের কোনো আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছি না। এজন্যই হয়তো তাদের মধ্যে হতাশা আছে এবং এজন্য অনেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আসা কেন্দ্রীয় সমন্বহীনতার বিষয়টি উড়িয়ে দেননি জাপা মহাসচিব। তিনি বলেছেন, দলের চেয়ারম্যান নিজের এলাকায়। আমিও নির্বাচন নিয়ে এলাকায় ব্যস্ত আছি। তাই বিষয়টি সমন্বয় করতে পারছি না। তবে নির্বাচনের পরিবেশ এখনো ঠিক রয়েছে। আমরা সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। যিনি জিএম কাদের হিসেবেও পরিচিত। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দলটির শীর্ষ এই নেতা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে সরকার কথা না রাখলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে এককভাবে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। যারা নেবে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলের ভিত্তি দুর্বল হবে?
জোবাইদা নাসরীন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টির ২৬টি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে যে সমঝোতা করেছে তা অনেক নেতাকর্মীই একাত্মবোধ করতে পারেনি। কারণ এসব আসনের বাইরে যেসব আসন রয়েছে সেগুলো নিয়ে জাতীয় পার্টির আসলে কোনো মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থা থেকে জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতারা যে বার্তাটি পাচ্ছে তা হচ্ছে, ‘মূল নেতৃত্বের কাছে আসলে নেতাকর্মীদের কোনো দাম নেই। তাদের কাছে দাম হচ্ছে যে চুক্তি বা সমঝোতা আওয়ামী লীগের সাথে হয়েছে, সেটির।’
এই বিশ্লেষক মনে করেন, যারা সমঝোতা হওয়া আসনের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘নেগলেকটেড বা অবহেলিত’ বোধ তৈরি হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের পরবর্তী সময়েও এই অবস্থার জের থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণে জাতীয় পার্টির ভিত্তি এবং জনগণের সঙ্গে দলটির সম্পর্কের একটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে। একই সাথে জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাদের সাথে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও আরও বেশি দূরত্ব বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে আসলে তৃণমূল নেতারা তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। কারণ আসন সমঝোতার দিকেই তাদের মনোযোগ ছিল। নেতাকর্মীদের সমর্থনের জায়গা যদি জাতীয় পার্টি হারিয়ে ফেলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভিত্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
এইউ/জেবি