আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন ধরে দর কষাকষি চলছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তবে কৌশলী আওয়ামী লীগ সবাইকে ঝুলিয়ে রাখে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত। অবশেষে রোববার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে শেষ মুহূর্তে শরিকদের কত আসনে ছাড় দেওয়া হচ্ছে তা জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে এবং ১৪ দলীয় জোটকে ছয়টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
তবে এতে পুরোপুরি মন ভরেনি শরিকদের। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ রয়ে গেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলে সুবিধা করতে পারবেন না- এমনটা বিবেচনায় তারা চুপ রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে নির্বাচন কমিশনে শরিকদের ছাড় দেওয়া আসনগুলোর তালিকা জমা দেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। পরে তিনি সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বিপ্লব বড়ুয়া জানান, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের জন্য ছয়টি আসন ছেড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে ২৬ আসনে। বাকি ২৬৩ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়বেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
কী বলছেন শরিকরা
এর আগে ১৪ দলীয় জোটকে সাতটি আসনে ছাড় দেওয়া হবে বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। সেই তালিকাও প্রকাশ করা হয়। তবে শেষ মুহূর্তে এসে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন একটি আসন কমিয়ে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরা-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে ছাড় দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি বাদ পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমরা সন্তুষ্ট নই। এটা অপ্রত্যাশিত। শেষ সময়ে এসে একজনকে বাদ দেওয়া খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এটা রাজনীতির নীতি বহির্ভূত কাজ।
মেনন বলেন, আমরা নির্বাচন করব। করার জন্যই এসেছি। দুটিতে নৌকা নিয়ে করব।
১৪ দলকে ছয়টি আসনে ছাড় দিলেও বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে ছাড় দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তিনি বলেন, আমার প্রতি অন্যায়, অবিচার করা হয়েছে। নৌকা দিলে দেবে, না দিলে নাই। আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। এত বছর ধরে এক সঙ্গে ছিলাম। নৌকার পক্ষে ছিলাম। এখন তারা (আওয়ামী লীগ) যদি আমার আত্মীয়কে (সুপ্রীম পার্টির চেয়ারম্যান) পছন্দ করে করুক।
এর আগে সাত আসনে ছাড় দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এবং ১৪ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। সেই ঘোষণায়ও ১৪ দলের শরিকরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তখন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এটা আমু (আমির হোসেন আমু) ভাইয়ের প্রাথমিক প্রস্তাব। আমরা এই প্রস্তাব মানি না। আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা আবার বিবেচনার কথা বলেছি। জোটের নেত্রী (শেখ হাসিনা) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। শরিকদের আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রত্যাহার করতে হবে। এটাও আমাদের জোর দাবি।’
এদিকে জাতীয় পার্টি গতবারও ২৬ আসনে ছাড় পেয়েছিল, এবারও একই সংখ্যা বহাল আছে। তবে সংসদের বিরোধী দল জাপা এটাকে সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বলতে নারাজ। তারা বলছেন, এটা সমঝোতা। যদিও আসন ছাড় নিয়ে দলে অসন্তোষ রয়েছে বলে জানা গেছে। কাজী ফিরোজ রশিদ, আবু হোসেন বাবলাসহ বর্তমান সংসদে থাকা কয়েকজন সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন দলের ছাড় না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ বলে সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া জাতীয় পার্টির অন্য প্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
নানা নাটকীয়তার পর রোববার বিকেলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এসে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঘোষণা দেন, সব মিলিয়ে ২৮৩টি আসনে লড়াই করবেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা।
তবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কতগুলো আসনে জাতীয় পার্টি ছাড় পেয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব তার মুখ থেকে কোনোভাবেই বের করতে পারলেন না গণমাধ্যম কর্মীরা। সংবাদ সম্মেলনে তার কাছে মূল প্রশ্ন ছিল আওয়ামী লীগ কতগুলো আসনে ছাড় দিয়েছে এবার। বারবার একটি কথাই বলেন জাতীয় পার্টির নেতা- ‘২৮৩টি আসনে আমরা নির্বাচন করছি।’
‘আমরা তো ২৬টি আসনের কথা শুনছি’, একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্নে ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ’ বলে উঠে চলে যান চুন্নু।
তাহলে সমঝোতার দরকারটা কী ছিল, দফায় দফায় এত বৈঠক কেন করলেন- একজন সাংবাদিক এই প্রশ্ন করলে চুন্নু বলেন, ‘এটা তো আমাদের দলের নিজস্ব কৌশল। সেটা তো আপনাকে জবাবদিহি করার দরকার নাই।’
যে ৩২ আসনে ছাড় পাচ্ছেন শরিকরা
জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া ২৬টি আসন হলো- ঢাকা-১৮ শেরিফা কাদের, ঠাকুরগাঁও-৩ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কিশোরগঞ্জ-৩ মুজিবুল হক চুন্নু, রংপুর-১ হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, রংপুর-৩ জি এম কাদের, নীলফামারী-৪ আহসান আদেলুর রহমান, কুড়িগ্রাম-১ মুস্তাফিজুর রহমান, কুড়িগ্রাম-২ পনির উদ্দিন আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ-৫ সেলিম ওসমান।
গাইবান্ধা-১ শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-২ আব্দুর রশিদ সরকার, সিলেট-৩ আতিকুর রহমান, নীলফামারী-৩ রানা মোহাম্মদ সোহেল, বগুড়া-৩ নুরুল ইসলাম তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আব্দুল হামিদ, চট্টগ্রাম-৮ সুলায়মান আলম শেঠ।
বগুড়া-২ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, সাতক্ষীরা-২ মো. আশরাফুজ্জামান, ফেনী-৩ মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৫ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পটুয়াখালী-১ এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, ময়মনসিংহ-৫ সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, ময়মনসিংহ-৮ ফখরুল ইমাম।
পিরোজপুর-৩ মাশরেকুল আজম রবি, হবিগঞ্জ-১ আব্দুল মুনিম চৌধুরী, মানিকগঞ্জ-১ জহিরুল আলম রুবেল এবং বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু।
এছাড়া ১৪ দলীয় জোটকে ছাড় দেওয়া ছয়টি আসন হলো-বগুড়া-৪ আসনে জাসদ প্রার্থী এ, কে, এম রেজাউল করিম তানসেন, রাজশাহী-২ আসনে বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বরিশাল-২ বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, পিরোজপুর-২ আসনে জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) আনোয়ার হোসেন এবং লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জাসদ প্রার্থী মোশারফ হোসেন।
জেবি